১
মেহেজাবিন খাবারটা দেওয়ার আগে নিজে জিভের উপর ঠেকিয়ে দেখে নিল। বেশ সুস্বাদু। আজকের দিনটা তাদের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
আজ এখানে, এই রেস্তোরাঁয় অনেক অতিথি আসবে । তাদের মুখের রুচি হরেকরকম
। সকলের মন জয় করে নেওয়া বেশ কষ্টের । চেষ্টা চলছে ।
মেহেজাবিন দেখল রান্না ঘরে কেউ নেই।
সে আলাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল , পশতু ভাষাতেই বলল – আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।
আলাবিনের বয়স মাত্র কুড়ি।
মরুভূমির রুক্ষতা ওর মুখে নেই
, যতটা মনের গভীর গহনে আছে
। আফগানি মেয়েদের চেহারায় বাঁধন থাকে
, চোখে দৃঢ়তা থাকে। আলাবিনের হাসিতে
প্রাণ খোলা দিকটা , মরুভূমিতে উড়তে থাকা তাপপ্রবাহ !
আলাবিনের হাসির কাছে , পৃথিবীর সব দুঃখই ম্রিয়মাণ ।
আলাবিন আর মেহেজাবিন এক সাথেই দেশ ছেড়েছিল।
এখানে ওরা অতিথি হয়ে আছে , ভিসার
মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়ে চলছে তাদের বেঁচে
থাকা । মাঝে -মাঝে আলাবিন মনে –মনে
ভাবে- এই পৃথিবীতে ভিসা আর পাসপোর্ট
নামক চুক্তিপত্রের দরকারই হতো না যদি , দেশ গুলো একসাথে
থাকত । এমনটা হওয়ার নয়। আফগানিস্থান থেকে ভারতবর্ষে
চলে আসবার পিছনে, যে স্মৃতি রয়েছে। সেই সব গুলো পুরোটাই ভালো নয়।
আবার খারাপও নয়। ভালো স্মৃতির
থেকেও রাতের অন্ধকারে রক্তাক্ত
হাতের মতন খারাপ স্মৃতি
ঘুমোতে দেয়না ! ভয় দেখায়, ফিরতে হবে ।
দিল্লিতে এসে আলাবিন অনেক কিছু দেখেছে।
এই দেশটাকে যত দেখছে ততই চোখে জল চলে আসছে
। এখানকার মানুষেরা হিন্দু , মুঘলরা , পাঠানরা সেই মরুভূমি থেকে
ঘোড়ার পায়ের ধুলোয় ভরিয়ে দিয়েছিল
এই পথ ঘাট। অনেক স্মৃতি
আর বিস্মৃতি মিশে গিয়েছে
, পথের আনাচে - কানাচে। আফগানিস্থান থেকে যেইদিন সে এই
ভারতে এসেছিল , দিল্লির
বিমানবন্দর থেকে গাড়ি করে খুব কাছেই
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ভাড়া করা
বাড়িতে এসেছিল ; নিজেকে অসহায় ভেবেছে। এক দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে
বসবাস খুব লজ্জার আর যন্ত্রণার।
হতভাগ্য না হলে কেউই নিজের বাড়ি থেকে নির্বাসন
নেয়না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
রান্না ঘরে ,রান্না করতে –করতে শুরুর দিনের কথা ভাবছিল আলাবিন। তার বয়স এখন একুশ বছর। এখানে
এসেছে প্রায় একবছর হয়ে গিয়েছে । আফগানিস্থানের সেই গ্রাম
, নিজের বাবা আর মা ,ভাইয়ের
কথাও ভাবছিল। আজ এখানে ওরা থাকলে বেশ হতো। তারা দেখত ,আলাবিনের হাতের
রান্না ,একটা নতুন দেশের মানুষদের মুখে হাসি এনে দিয়েছে।
মেহেজাবিন কানের
কাছে এসে বলল – আজকে আসবে তো ?
আলাবিন হাত দিয়ে
সোনালি চুল সরিয়ে, মুখটাকে আবেগহীন করে বলল – কে?
মেহেজাবিন হারবার মেয়ে নয় , বয়স তিরিশ। বলল - তোমার প্রমথেশ মিত্র। বাঙালি
বাবু।
মেহেজাবিন এর কথায় নিরুত্তাপ হয়ে আলাবিন
বলল - প্রমতেশ বাবুর কথা আমি জানবো
কেমন করে ! তুমি সবসময় খুব বাজে মজা করো। যদি কেউ শুনতে পায় , ওনার সম্বন্ধে
খারাপ ভাববে।
মেহেজাবিন হেসে বলল – যদি কেউ ভালোবেসে বদনাম হয় , তার স্বর্গ লাভ হয়।
কেন রে তুই আদম খান আর দূর খানাই এর
কাহিনী শুনিসনি !
আলাবিন হেসে বলল- দিদি ,সেই সব গল্প। লোকের মুখে শুনেছি ; সত্যি
নয়। এখানে এই বিদেশে
এসে একজন ভালো ভারতীয়কে
কয়েকদিনের পরিচয়ের জন্য অপমানিত কেন করবো
? আমরা এই দেশের অতিথি, কতদিনই বা থাকবো !
মেহেজাবিন বলল - আলাবিন , আমাদের মতন মেয়েদের ভাগ্যে ভালোবাসা অল্প
সময়ের জন্য আসে । ভালবাসা যে ঈশ্বরের আত্মা , সেখানে পবিত্রতা ছাড়া কিছু নেই ।
-নিজেদের ভিতরে যে অনুভূতি , আমাদেরই থাক ।
- সব কিছু লুকিয়ে রাখা গেলেও
, ভালোবাসা বুঝতে পারবে
। প্রমথেশ বাবুর
চোখেও তোর
প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেখেছি , প্রথম দিন থেকেই ।
২
দুমাস আগে
, ভারতবর্ষ ওদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল।
আফগানিস্থান থেকে তালিবানি অত্যাচারে
বেশ কিছু মেয়ে বাঁচতে ভারতে
চলে আসে ; আলাবিন
আর মেহেজাবিন তাদের সাথেই এসেছিল।
দিল্লিতে ভারতের একটি এন জিও তাদের আশ্রয়
দেয় । কথা হয়েছে
, তিনমাস এখানেই থাকবে , অবস্থা ঠিক হলে দেশে
ফিরবে। সেটা সম্ভব না হলে ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি
করা হবে ।
মেহেজাবিনের বয়স তিরিশের
উপরে মধ্যবয়স্ক। দুজনেই আফগানিস্থানের প্রত্যন্ত গ্রাম
থেকে এসেছে। প্রথম যেই দিন আলাবিনরা ইন্দিরাগান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামল , তাদের নিতে এসেছিল প্রমতেশ মিত্র। উচ্চতা ছয় ফুট ছয় ইঞ্চি।
গায়ের রং মাঝারি। এন জিওটির
দিল্লি শাখার প্রধান। প্রথম
দেখাতেই লোকটির সততা আলাবিনের
ভেঙে যাওয়া মনে নতুন করে
সুর দিয়েছিল !
মানুষের মন সেতারের মতনই
অনবরত বেজে
চলেছে। মন নিজেই সুর খুঁজে মেতে ওঠে
। মানুষের মনের ভিতরের এই খেলা , দিন রাত হয়ে চলেছে।
আলাবিনের চোখে যে অতীত
ছিল , সেখানে
নারীরা পরাজিত , শোষিত , হেরে
যাওয়া এক
শ্রেণী । ধর্মের নামে অত্যাচার চলেছে । এই
অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতেই , যেখানে জন্মেছিল সেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে
আসা।
ভদ্রলোকটি এগিয়ে এসে হিন্দিতে বলল - আমার নাম প্রমথেশ ।
আলাবিন হিন্দি বুঝলেও ইংরাজি একদম শেখেনি। পশতু তার মাতৃভাষা। ভারতের হিন্দি সিনেমা সে দেখেছে
, সেখান থেকেই আর ভারতে আসবার পর কিছুদিন নিজের তাগিদেই
, হিন্দি শিখেছে । অন্তত বলতে পারে , কেউ বললে বুঝতেও
পারে ।
আলাবিন হিন্দিতেই বলল - প্লেনে,
আপনাকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল।
প্রমথেশ
বলল - আমার
নামে খুব ভালো কথা হয়তো কেউ বলেনি ।
-বুঝলেন কেমন করে ?
-আমি লোকটা ভালো নই।
আলাবিন মুচকি হেসে বলল - আপনার মহিলা কর্মীরা কিন্তু
আপনাকে খুব পছন্দ করে।
প্রমথেশের মুখ লাল হয়ে গেল ! বলল – হ্যাঁ ওরা খুব শ্রদ্ধা করে । আমাকে বেশী
ঝামেলা নিতে হয়না।
মেহেজাবিন বলল - সে ঠিক
। আপনাকে নিয়ে ওদের মধ্যে এতো প্রশ্ন শুনেছি , এতো কৌতূহল
দেখেছি , আমিও আপনার প্রেমে পড়ে গেলাম
!
এই কথা গুলো বলে হিঃ হিঃ করে হাসতে
শুরু করল । হাসিটা
এতোটাই সরল ,
প্রমথেশ
হাসির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে ছিল । বলল -
আপনারা আমার দেশে এসে , আমাকে
নিয়েই মজা করছেন ?
আচমকাই ভারী আবহাওয়া জড়ো হয়েছে
, এই শান্ত মজা বুঝতে অসুবিধা হয়েছে বলেই , কিছুক্ষণ
তিনজনেই চুপ করে ছিল
, প্রমথেশের
মুখে হাসি দেখে ,ওদের চোখে স্বাভাবিক
পরিবেশ ফিরে এলো ।
এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাবটা ওদের নিয়ে এগিয়ে চলেছে । নভেম্বরের রাস্তা ,
দূষণে রাজধানীর মাথায় ধোঁয়া জমছে ,
শ্বাস নেওয়া বেশ সমস্যার । চারপাশ দেখছে , বহুদিনের প্রাচীন
শহর , অনেক স্মৃতির উত্থান আর পতনের সাক্ষী
হয়ে রয়েছে এই শহর। রাস্তায় রাস্তায় সৌধ, ইন্ডিয়া গেটের সামনে দিয়ে যখন ক্যাব
ঘুরছিল , ঘড়িতে বেলা বারোটা দশ । সেই দিকে তাকিয়ে
প্রথম ভারত দেখার উত্তেজনায় মেহেজাবিন ভাঙা হিন্দিতে
বলল – আমি এখনো ভাবতে পাচ্ছিনা , আমরা শেষ পর্যন্ত ভারতে ! উফ ! তোমরাও বুঝতে পাচ্ছনা
, আমরা ভারতের প্রতি কতোটা দুর্বল ! আফগান আর ভারতের সংস্কৃতি একে অপরের সাথে মিশে
রয়েছে ! আমরা আফগানিরা ভারতকে আমাদের
স্বপ্নের দেশ ভাবি।
ক্যাব ঘুরছে আকবর রোডের উপর উঠল। প্রমতেশ বলল – আর কিছুক্ষণ
বাদেই আমরা
সাকারপুর খাস দিল্লিতে উঠে যাবো। ওখানেই
আমাদের হোমটা। আপনাদের জন্য সব ব্যবস্থা করাই আছে ।
মেহেজাবিন বলল –
আপনি তো আমাদের সাথেই থাকবেন
।
প্রমথেশ মাথা চুলকে নিয়ে বলল – ম্যাডাম খুব ইচ্ছা থাকলেও
হবেনা ।
আমাকে আজকে রাজ্যপালের সাথে দেখা করতে যেতে হবে । আপনাদের বিষয়টা থাকবে , আমরা
ভারতীয়রা অতিথি সেবার সাথে
একদম কম্প্রোমাইজ করিনা।
-তারমানে আমরা এখন একদম একা ! সম্পূর্ণ অপরিচিত
!
প্রমথেশ আলাবিনের চোখে অশ্রুর ছাপ দেখতে পাচ্ছে , কান্না অনেক সময়ই অন্তর্মুখী ! ক্যাবের একপাশে সে রাস্তার দিকে
তাকিয়ে আছে , এমন ভাব যেনও এইসবে
তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই ! হাওয়ায়
কপালে ছড়িয়ে থাকা চুল
উড়ছে , হাত দিয়ে
সরিয়ে নিল নিজেই ।
মানুষের আবেগের
বহিঃপ্রকাশে, তার নিজের
হাত নেই । আলাবিনের মুখের উপর সোনালি চুলের
গোছা ; আফগানি বালুরাশি মনে হচ্ছে ; মেয়েটির চোখের ভাষায় -
অসহায়তা, একা হয়ে যাওয়ার
নিরাপত্তাহহীনতা , প্রমতেশের কাছে ফিরে আসছে !
তাদের পরিচয় হয়েছে খুব বেশী সময়ের জন্য নয় । এর আগে পরস্পরের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল ।
আলাবিন মাথা নামিয়ে ভাঙা হিন্দিতে বলল – আপনার ব্যস্ততা আমরা বুঝি । আমাদের
মতন কত শরনার্থী আসছে । আমাদের
নিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। আমাদের অসুবিধা
হবে না ।
প্রমতেশের আলাবিনের কথাটা , খারাপ লাগল
। মেয়েটা খুব সোজাসাপটাই উত্তর দিল ,
অথচ এই
কথা গুলো
মেনে নিতে পাচ্ছে
না । আমাদের ভালোলাগার
মাঝে দেশের , ভূখণ্ডের পরিচয় অনেক বড় হয়ে যায় ! আফগানিস্থান ভারতের পাশেই , সেখান থেকে অনেকেই
এই দেশে এসেছেন , ভারত
শাসন করেছেন , এরা সবাই ভারতকে
ভালোবেসে এসেছে এমন নয় ; নিছক লুঠ করবার
জন্যও
এসেছে। ইতিহাসের বইয়ে , কোন এক অদৃশ্য
রাজনৈতিক অভিসন্ধিতে , সেই সব
বর্বর , দস্যুদের হিংস্রতার
কথা নায়কোচিত ভাবে বলা হয়েছে । আলাবিনের
মতন মেয়েরা যে তীব্র লড়াই চালিয়ে
যাচ্ছে ভারতে থাকা স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠন গুলোতে খোঁজ নিলে সেই সব কিছু জানা যায় ; আমরা
কত জনেই সেই খবর রাখি ! তাদের
ইতিহাস ভারতীয়রা জানতে পারবে ? পৃথিবীতে
কোথাও শরনার্থীদের ইতিহাস
লেখা হয়নি , তাদের রাজনীতির উপাদান
বানিয়ে রাখা হয়েছে ।
প্রমতেশ আলাবিনের দিকে তাকিয়ে বলল – আমার ফোন নম্বর নিয়ে নাও । তোমার
ভারতের নম্বর ভিতরে দেওয়া হবে । নতুন ফোন , নতুন সিম । যেহেতু তোমাদের
রেসকিউ করে
আনা হয়েছে , জঙ্গিরা তোমাদের
টার্গেট করতে
পারে । আমরা নম্বরটা নতুন দিয়েছি । কোন সমস্যা হলেই আমাকে
ফোন করবে।
সেই শুরু সম্পর্কের। আলাবিনের সাথে খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রমতেশের সম্পর্ক এগিয়েছে। তাদের সম্পর্ক
ক্রমশই এগিয়েছে , আলাবিনের
কাছে প্রমথেশ নিরাপদ আশ্রয় , দিন গিয়েছে , বেড়েছে নির্ভরতা।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক গভীর হয়।
যত বেশী তাদের মধ্যে কথা হবে , একে অন্যের পাশে বসে কথা বলবে , মন খুলে মজা করবে ,
নিজেদের প্রতি সম্পর্কের বিশ্বাস
শক্ত হবে । দিল্লিতে অনেক কিছু দেখবার আছে । প্রতি রবিবার প্রমথেশরা এন জিওর সবাইকে
নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করে । তিনটে গাড়িতে হোমের সবাই থাকবে
। বাইরেই খাওয়া দাওয়া
হবে । সারাদিন মজা আর হইহুল্লোর
। দিল্লিতে ঘুরবার
জায়গার অভাব নেই ।
নভেম্বরের শীতকালীন বিকেলে ,
আকাশের আলো ক্রমশই থেথো করা হলুদের
মতন হয়ে আসছে । দিল্লিতে
সন্ধ্যা নামতে দেরী করেনা । আলাবিন উদাসীন
চোখে সেই পাল্টাতে থাকা আকাশের
দিকে তাকিয়ে বলল – প্রমতেশ , আমাদের গ্রামে মাঠ ছিল না । সবুজ
ঘাস ছিল না। জলের অভাব ছিল। বালিতে
বড় বড় জংলা
গাছ , শুকিয়ে
গেছে । আমি
বিকেল এমন ভাবে দেখিনি ! এখানে
স্বাধীন ভাবে দেখতে পাচ্ছি । চিন্তা করছি । আমাদের দেশের
মৌলবিরা স্বাধীনতা পছন্দ করে না। স্বাধীন চিন্তা কে ভয় পায়।
প্রমথেশ বলল – সব মৌলবি নয় । কাল একজন মৌলবি
আফগান নারীদের পক্ষে
কথা বলে তালিবানিদের গুলিতে
মারা গিয়েছেন। সে মৃত্যু
নৃশংস । এই দেশেও অনেক মুক্ত চিন্তার মানুষদের হত্যা করা হচ্ছে
। বাংলাদেশে এমন খুন প্রায়
প্রতিদিনই হয়ে চলেছে , তাতেও প্রতিবাদ
থেমে নেই । পৃথিবীর
সব মৌলবাদীরাই স্বাধীন
চিন্তাকে ভয় পায় । ওদের ভিতরে যে ভয়টা লুকিয়ে
আছে , সেই ভয়টাকে
অস্বীকার করবার জন্যই , মানুষের স্বাধীন
চিন্তাকে শেষ করে দিতে চাইছে । পৃথিবীতে যেইদিন
সব স্বাধীন চিন্তা হারিয়ে
যাবে , সব মানুষই
মৌলবাদী হয়ে উঠবে
! তুমি পালিয়ে
এসেছো , স্বাধীন ভাবে বেঁচে
থাকবার লড়াই করছো ,
এই লড়াই
থামিয়ে দিও না ।
আলাবিনের চোখ ভিজে
উঠেছে , বলতে শুরু করল – আমার বিয়ে ঠিক ছিল। পাশের
গ্রামের ছেলে । একদিন শুনলাম তালিবানরা
পাশের গ্রামটাকে তছনছ করে দিয়েছে ।
আমাকেও সেই রাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেল , সারারাত ধরে ওরা আমাকে আঁচড়ালো ...
আমার শরীর জুড়ে যে যন্ত্রণা , মনের ভিতর রক্তের ধারা বইছে । আমি
ওদের কামনা পেলাম । এই শরীরকে , বারবার ধর্ষিত
আত্মা মনে হয় । তোমার সাথে কথা বলবার আগে আমি জানতেও পারিনি
কোন পুরুষ আমার সাথে
মানুষের মতন মিশবে ! সেই
রাতগুলো আমাকে তাড়া করে
।
আলাবিন কাঁদছে । বাকীরা অনেকটা দূরে রয়েছে , খাওয়া
হয়ে গিয়েছে , গাড়িতে সব জিনিসপত্র
তুলে নেওয়া হচ্ছে । সূর্য ডুবেছে
। আলাবিনের মাথায় প্রমতেশ
হাত বুলিয়ে দিল। মেয়েটাকে খুব চেনা বলে মনে হচ্ছে । ধর্ষিত
, লাঞ্ছিত মেয়েদের যন্ত্রণা যখন
ফুটে ওঠে ; প্রমতেশের নিজেকে অসহায় মনে হয় , খানিক
ক্লিব মনে হয় , পুরুষের প্রতি যে ঘৃণা নিয়ে
এইসব মেয়েরা বেঁচে
থাকে , নিজেকে অপরাধী মনে হয় । প্রমতেশ পুরুষ।
প্রমতেশ অপরাধী ।
ভেজা চোখ থেকে জল গড়িয়ে দুইদিকের গাল ভিজিয়ে দিয়েছে । প্রমতেশ
দেখল , আলাবিনের মুখে অদ্ভুত পবিত্র
খুশি । মেয়েটার মন হাল্কা হয়েছে।
ফর্সা গালে লাল উষ্ণতা দেখা যাচ্ছে
, পার্কের ভিতরে আলোর ব্যবস্থা আছে , হ্যালোজিনের আলোয় আলাবিনকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছা করছে ।
সবুজ আফগানি চুড়িদার ,
খোলাচুল , চোখের সুরমা , আফগানি
সুন্দরি। প্রমতেশ বলল –মন হাল্কা
হয়েছে ?
আলাবিন বলল –তুমি খুব ভালো । এখানে এসে তোমার মতন বন্ধু পেয়েছি , আমার সব কষ্ট হয়তো তাড়াতাড়ি
ভুলতে পারবো না , চেষ্টা
করবো ।
-আলাবিন আমাদের হোমে অনেক ধর্ষিত ভারতীয় মেয়েদের
আসতে দেখেছি । তাদের জীবনের মূল স্রোতে
ফিরতেও দেখেছি । সব পুরুষ
খারাপ হয়না । মানুষকে সুযোগ দিতে হয় । আমাকেও দিয়ে দেখো
, তোমার বিশ্বাসে আঘাত করবো না।
আলাবিন, প্রমথেশের হাত ধরল। তাদের ভিতরে সম্পর্ক শুধুই বন্ধুত্বের ? এর থেকেও বেশী কিছু ? ফিরতে হবে ওদের ।
৩
তাদের মধ্যে সম্পর্ক এগিয়েছে । আলাবিনের
সেইদিনের কথা এই
তিনমাস বাদেও স্পষ্ট মনে আছে । প্রতিদিন
তাদের দুজনের মধ্যে ফোনে কথা হয় । প্রমতেশ একদিন আলাবিনকে
প্রস্তাব দিল , তারা কেন রেস্তোরাঁ খুলছে না ! আলাবিন বলল – এখানে রেস্তোরাঁ
খুলতে হলে টাকা দরকার । তাদের কাছে এতো
টাকা নেই ।
প্রমথেশ আর আলাবিন সেই দিন হোমের দরকারেই পুরানো দিল্লিতে মার্কেট করতে গিয়েছে
। মার্কেটের আঁকাবাঁকা
গায়ে-গায়ে লেগে থাকা
দোকানে অন্ধকার গলিতে ঘুরছিল। দুপুর
দুটো । তাও গলির অনেক জায়গায় আলো ছুঁতে পারেনা । সারাদিন
শপিং করেছে। পেটে ক্ষিধে
। একটা পুরানো
রেস্তোরাঁয় , মুখোমুখি বসে আছে দুজনে ; তখনই প্রথম প্রমতেশ বলল – এইরকম একটা রেস্তোরাঁ খুলতে পারি আমরা ।
আলাবিন সবুজ কাঁচ বসানো চুড়িদার পড়েছে , সুর্মা একেছে চোখে , কানের দুল দুটো মাঝের দুপুরের
শক্ত রোদে চমকাচ্ছে , মেহেন্দি ভরা দুটো
হাত , সোনালি
চুল বেঁধেছে , হাত দিয়ে
পনির ঝোল মাখা পরোটা
ছিঁড়ছিল ।
আলাবিন বলল - টাকা পাবো কোথায় ?
-আমাদের এনজিও প্রয়োজনে ঋণ নেবে । তোমরা
শুধু ব্যবসাটা মন দিয়ে
শুরু করো ।
কিছুক্ষণ থেমে আলাবিন বলল - শুরু করবো
, এই দেশে আমরা নতুন । তেমন
ভাবে জানিও না এখানকার মানুষের
স্বাদ , চাহিদা । আমাদের রান্না ভালো লাগবে কেন ? এই
দেশের মানুষদের আমরা তেমন ভাবে জানিনা
, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছি
। আমরা তাদের মনের মতন খাবার তৈরি করে দিতে পারবো
!
প্রমতেশ মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে । নিষ্পাপ চোখ । বলল – তুমি এতো ভয় পাচ্ছও
কেন ? জীবনে
এই পর্যন্ত অনেক লড়েছো , না হয় আরেকবার আরও একবার লড়লে । আফগানি
মেয়েরা এতো
ভীতু হয় !
আরাবিন চোখ দুটোকে গোল করে বলল - মোটেও নয় ...
দুমাস আগের কথা , আজ সন্ধ্যা সাতটার সময় স্মৃতি
থেকে আচমকাই দুমাস
আগের ঘটনা য় গিয়েছিল , এখন বর্তমানে
চলে এলো ! মার্চের সান্ধ্যকালীন আড্ডায় , দিল্লির এই রেস্তোরায় আসর বেশ জমে উঠেছে। ব্যস্ত
রাস্তা থেকে , দিল্লির কিছুটা নিরিবিলি জায়গায়
রেস্তোরাঁটা । ভারতের হাই কমিশনের
অফিসারদের সাথে , ভারতে থাকা আফগানিস্থান
দূতাবাসের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অফিসারদের অনেকেই আসবেন ।
আজই প্রথম আলাবিনদের উদ্বোধনী
সন্ধ্যা ।
প্রমতেশের এই পরিকল্পনার পিছনে প্রধান
কারন , আলাবিনদের স্বতন্ত্র পরিচয় । সে মেয়েটাকে
সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে
হয়তো ! আলাবিনের মনেও ভালোবাসা
আছে ? প্রেম খুব নিরীহ , অথচ নিষ্ঠুর । স্থান , কাল
, পাত্র কিছুই মানে না । আচমকাই নিজেকে
জানান দেয় ; আলাবিনের
আর প্রমতেশের প্রেমের গল্প যদি লেখা হয়
; আমি
চাইবো ওরা এক হয়ে যাক। দুজনেই
একসাথে সারাজীবন কাটিয়ে দিক ।
আমি নিজেও
জানিনা ওদের ভবিষ্যতের
কথা । এতটুকু বুঝে গিয়েছি
, ধর্ম আলাদা
, দেশ আলাদা । ভাষা আলাদা ----
ওরা এতো কিছুর সত্ত্বেও আলাদা নয় ! প্রেম নতুনই
থাকে , সে পুরানো হলেও নতুন
; মানুষের ভিতরে এখনো স্বপ্ন আছে ,
আবেগ আছে , বেঁচে
থাকার যন্ত্রণা আছে , সৃষ্টির
তাগিদ আছে । মানুষ এমন ভাবেই
এগিয়ে যাবে।
কাতার সিং একজন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ভারতীয় দূতাবাসের আধিকারিক। আলাবিন
নিজের হাতেই পরিবেশনা করছিল ।
কাতার সিং কাবুলি পোলাও মুখে দিয়ে
ইংরাজিতে বলল - খাসা।
এমন রান্না
সত্যিই এই প্রথম খেলাম
।
পেহেলু এনজি ওর ক্যাশিয়ার , বলল- স্যার
, এখানে অনেক আফগানি
রেস্তোরাঁ থাকলেও আমাদের রেস্তোরাঁর রাঁধুনি আফগান
থেকে এসেছে ।
তার এই কথায় সবাই হেসে উঠল । আসর আরও জমে গেল ...
অনেক রাতে অতিথিরা ফিরে গিয়েছে। দিল্লির
শীত তখন আকাশের কুয়াশাদের নিয়ে , রেস্তোরাঁর সামনে যে সবুজ বাগান রয়েছে ;
রঙিন পাহাড়ি ফুল গুলো অপেক্ষা করছে রাত
শেষ হবে , সূর্য উঠবে , ফুটবে । ধীরে –ধীরে
রেস্তোরাঁর সব আলো নিভে যাচ্ছে । এখন রাত এগারোটা , ভিতরে
এখনো ব্যস্ততা কমেনি । বাইরে বাগানের ফোয়ারার
কাছে আলাবিনের মাথা প্রমতেশের কাঁধে । বলল – ওরা আমাদের রেস্তোরাঁকে
নির্বাচিত করবে ?
প্রমথেশ
বলল – আমারা এই
প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি , এটাই আমাদের পাওয়া । যদিও ওদের কাছে সেরা রেস্তোরাঁর রাঁধুনিদের
স্কলারশিপ দেওয়ার ব্যবস্থা
আছে । তাও চেষ্টা করেছি আমরা ।
-পৃথিবী জুড়ে এমন কতো শরণার্থীদের স্বনির্ভর রেস্তোরাঁ আছে । তাড়াও আমাদের মতন অসহায় ! আমি তাদের
জেতাতেও আমার জয় দেখবো।
প্রমথেশের
কাঁধে মাথা রাখা মেয়েটার দিকে চোখ রেখে বলল – আমি চাইবো আমাদের রেস্তোরাঁকে ওরা নির্বাচিত করুক । আমার আলাবিন জিতুক ।
আলাবিন প্রমথেশের
চোখের দিকে তাকিয়ে আছে । সে নিজের ঠোঁট এগিয়ে দিল । প্রমথেশ এই প্রথম নারীর নরম ঠোঁটের উষ্ণতা পেল !
আলাবিনকে চুমু খাওয়ার
সময় সে টের পেয়েছে
, মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরেছে ।
আলাবিনের বাঁধা খোঁপা
খুলে গিয়েছে ।
আলাবিন আরেকবার জল ভরা চোখে বলল
– আমি আর শরনার্থী
হয়ে থাকতে চাইনা । আমাকে ছেড়ে যেওনা... আমার চাওয়া খুব সামান্য ।
ভালোবাসা আমার কাছে সবচেয়ে দামী ।
আকাশে নিঃসঙ্গ চাঁদের আলোয় মিশেছে , নক্ষত্রদের স্পর্শহীন যন্ত্রণা।
এখানে যে
নিস্তব্ধতা , শব্দহীন অনুভূতি ওদের ঘিরেছে, সেই সব ভাষা আসলে কবিতার মতনই সত্যি , আবার
বাক্যহীন। নিঃশ্বাসের যেমন উপস্থিতি থাকে , দৃশ্য
থাকেনা। আলাবিনের ভিতরে যে ভালোবাসার নদী বইছে
, শব্দ নেই । উপস্থিতি আছে।
কান্না ভেজা গলায় আলাবিন
বলল - প্রমথেশ ইলহাম মানে জানো ?
প্রমথেশ বলল - না ।
-প্রেরণা সৃষ্টি করে যে ।
-তাহলে তুমিই আমার ইলহাম ।
আলাবিন মিষ্টি করে হাসল , - না তুমিই আমার ইলহাম
।
৪
আরাবিন এখন রোমে । তাদের রেস্তোরাঁকে সেরা শিরোপা
দেওয়া হয়েছে । তাদের
স্কলারশিপ দিয়ে রোমে নিয়ে যাওয়া
হয়েছে । তারা সেখানে শুধু রান্না শিখেছে
তাই নয়
, এক বিদেশি রেস্তোরাঁয় মোটা বেতনে কাজ করছে ।
আরাবিন তিনবছর ভারতের
বাইরে ।
মুম্বাইয়ের ১২০০ স্কোয়ার ফিটের দ্বোতলার ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বছর তিরিশের রুগ্ন চেহারার
পামেলা সেন । সে তাকিয়ে আছে , দেখছে সামনে
সবুজ লনে তিনবছরের
মেয়ে লিয়াকে
নিয়ে , রবিবারের অবসন্ন
বিকেলে খেলছে প্রমথেশ
মিত্র ;
তিনবছর আগে দেখেশুনে
বিয়ে করেছে ।
আরাবিন দিল্লি ছেড়েছে আজ থেকে প্রায় চারবছর
আগে ।
আরাবিন আর প্রমথেশের মধ্যে এখনো কোন সম্পর্ক
আছে ? তাদের মধ্যকার দূরত্বের
কারণ ? আজ থাক , সে গল্প অন্যদিনের
জন্য .........