নষ্ট মেয়ের গল্প
আদিত্য
,আমি চলে যাচ্ছি। আবার কবে কোথায় কিম্বা আদৌ কোনদিন দেখা হবে কিনা জানিনা। অবশ্য
তুমি জানো আমি বিশ্বাস করি আমাদের জীবনের সব কিছুই প্রি-ডিটারমিনড
,পূর্ব-নির্ধারিত।কেউ আমাদের অলক্ষ্যে স্ক্রিপ্ট লিখে রেখেছেন,আমরা সেই নির্দিষ্ট চরিত্রটায় অভিনয় করে চলেছি মাত্র। তাই এই মুহূর্তে
নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছিনা তোমার আমার আবার কখনো দেখা হয়ে যাবে কিনা!
পরিচয়ের দুদিনের মাথায় তুমি বলেছিলে ,তোমার –আমার যে রিলেশন তৈরি হতে
চলেছে তাতে যেন কোনোদিন কোনো অধিকারবোধ ,দাবি,দায়িত্ব নেওয়ার অঙ্গীকার ,এমনকি
ভালবাসা শব্দটাও না আসে। তোমার সে দিনটা মনে আছে আদিত্য ?সন্ধ্যে নামার একটু আগে
সিটি সেন্টারের সামনে থেকে তোমার কালো মার্সিডিজে আমায় তুলে নিয়ে নিউটাউনের দিকে ঘুরিয়েছিলে। সবে
মাত্র আগের দিন তোমার সঙ্গে মিতুলের জন্মদিনে পরিচয় ।মিতুল বোধহয় তোমার মামাতো বোন
, আমার বান্ধবী।বোর ফিল করছিলাম
,উচ্চস্তরে মিউজিক বাজছিল,ভালো লাগছিল না আমার,তোমারও ।একটা ধারে দাঁড়িয়ে আমরা কখন
যেন কথা বলতে শুরু করেছিলাম ।তারপর ফোন নম্বরের আদান-প্রদান। পরের দিনই তুমি মেসেজ
করেছিলে দেখা করতে বলে। আমিও মনে মনে তাই চাইছিলাম।
গাড়িতে
তোমার কথা শুনে আমি বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম ,তাহলে আমাদের এই রিলেশনটা কেমন
হবে?
‘এটা
কেবল আনন্দের জন্যে হবে,যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন যেন শরীর, মন সবটাই অদ্ভুত
সুখে –আনন্দে মেতে ওঠে ।কিন্তু শুধু সেই মুহূর্তটাই। তারপরে আমাদের কারও প্রতি কারও
দায় থাকবে না’-তুমি বাঁ হাত দিয়ে আমার কাঁধ স্পর্শ করে বলেছিলে ।
এই
দায় না নেওয়ার বিষয়টা সেদিন আমার মাথায় ঢোকেনি।কিন্তু এটা বুঝেছিলাম তুমি কোনো
বন্ধনে জড়িয়ে পড়তে চাওনা।ভাল লেগেছিল তোমার সরল স্বীকারোক্তি। কারণ আমি নিজেকে
যতটা চিনি, জানি, তাতে বুঝতে পারি বন্ধনে আমিও বেশিদিন আটকে থাকতে পারিনা।দমবন্ধ
হয়ে আসে,মুক্তি খুঁজি... । তাই তোমার কথা মেনে নিয়ে বলেছিলাম, সূর্য আর চাঁদের কখনো
এক সঙ্গে থাকা হয়না ।
তোমার
সঙ্গে আমার যে নিয়মিত দেখা হয়তাও তো নয় ।কথাও অনিয়মিত। অথচ সেদিনের সেই অল্প
দূরত্বের জার্নিটা ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছিল।রাস্তাটা ক্রমশ ময়াল সাপের মতো এঁকে বেঁকে
আমাদের নেশা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
আজ
আট বছর বাদে পিছন ফিরে দেখতে গিয়ে দেখলাম এই এতগুলো বছরে তুমি আমায় একটা জিনিসও
দাওনি যা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে আমি রাখতে পারি। আসলে তুমি আমাকে কখনও কোনো উপহারই
দাওনি।প্রথম প্রথম তুমি বিদেশে গেলে ভাবতাম আমার জন্য নিশ্চয়ই কিছু আনবে।দু-একবার তোমায় বলেও ছিলাম, মনে
আছে তোমার?
তুমি
জিজ্ঞেস করেছিলে ,- বলো কি লাগবে তোমার ?
আমি
মনে মনে আকাশ পাতাল খুঁজেছি।অথচ একটা জিনিসেরও নাম মনে করতে পারিনি যা তোমায় বলা
যায়,শুধু বলেছি – ইচ্ছে হলে এনো কিছু ,কিন্তু তাড়াতাড়ি ফেরো।
‘কেন
?তাড়াতাড়ি ফিরলে কি হবে?’তুমি প্রশ্ন করেছ।
‘কি
আবার হবে?’ উদাস ভঙ্গীতে বলেছি ।
‘ফিরে
এসে তোমায় আরও নিবিড় ভাবে চাই’।
ততটাই
শান্ত ভাবে বলেছি , ‘ফেরো।’
তুমি
আবার জিজ্ঞেস করেছ , ‘বল কেন ফিরব?কি চাই?’
‘তা জানিনা।শুধু মনে হয় তুমি এখানে থাকলে আমি খুব সিকিওরড।আমার যাবতীয়
দায়- দায়িত্ব ,চাওয়া-পাওয়া-সব যেন তোমার... তুমি দু’ হাত দিয়ে আগলে রাখবে আমায়’।
তুমি হেসে বলেছ ,’উঁহু –নো দায়িত্ব ...’।
আমার
সম্বিত ফিরে এসেছে।সত্যিইতো আমাদের মধ্যে এরকম কোনো কমিটমেন্ট নেই।শুধু কিছুক্ষণের
শারীরিক উত্তেজনা ।তুমি বল , ‘এটাই সুখ।মন নিয়ে বেশি ঘ্যানঘ্যান করতে নেই। বোকা
বোকা বিষয় ।তাছাড়া শরীর দিয়েও মন ছোঁয়া যায়।জাস্ট এনজয় ইট’।
আমি
এ সুখের মানে বুঝে উঠতে পারিনি ।শুধু আরো জোরে তোমার বুকে মুখ গুঁজতে চেয়েছি।
বিদেশ
থেকে তুমি টেক্সট করেছ –‘চন্দ্রানী, প্রচণ্ড শীত,জমে যাচ্ছি,একটা খোলামেলা ছবি
পাঠাও’।
-‘পারব
না’।
-‘প্লিজ...’
-‘
রাস্তায়’।আমি রিপ্লাই করেছি ।
-‘বেশ
ঘরে ফিরে পাঠাও ।একটু উষ্ণতা দাও,নইলে মরে যাব...’।
-‘তাহলে
মরেই যাও’।আমি লিখতে চেয়েছি।কিন্তু তা না লিখে লিখেছি ,
-‘পারবনা।ওখানেই
কাউকে ডেকে নাও’।
-‘তাহলে
আর এ জন্মে তোমাকে পাওয়া হল না।দেশে ফেরাও হল না।নির্ঘাৎ ...’।তুমি ভয়ের চিহ্ন
পাঠিয়েছ ।
-‘বেশ,
তবে প্রোটেকশন নাও’।
-‘না।আমি শুধু তোমাকে চাইছি।একটা ছবিই তো শুধু পাঠাবে ,এত ঢং করছ কেন?’
এ
যেন আমার উপর দাবি !ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে ।কি ভাবে আমায়! যা বলবে শুনতে আমি বাধ্য
নাকি!এদিকে বলে কোনো অধিকার ,কোনো ভালবাসা ,কোনো দাবি নেই,আর এখন রীতিমত জোর
ফলাচ্ছে !রাগে শরীর কাঁপে , নিঃশ্বাস বন্ধ
হয়ে আসে।চেনা রাস্তা দিয়ে বাড়ি না ফিরে এলোমেলো ঘুরি।
‘ভুলে
যেওনা ,আমি তোমার স্ত্রী বা কর্মচারী নই,তোমার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।’ বলে মোবাইল অফ করে দিই। অনেক রাতে বাড়ি ফিরে স্নান করে মোবাইল অন করা
মাত্র তোমার , ‘প্লিজ ,একটা ,মরে যাচ্ছি...’ টেক্সট দেখে মন কেমন করে ।তারপর
বুদ্ধি বিবেচনা শিকেয় উঠিয়ে স্বল্প পোশাকে ছবি তুলে তোমাকেই পাঠাই ।
পরদিন
তুমি জানিয়েছ ,-
‘ফাটাফাটি
ফিগার ।দেখেই এনজয় করলাম ।ঘুমও দারুণ হল ।থ্যাঙ্কস ডিয়ার’।
আমি
রাগে প্রতিজ্ঞা করেছি ,না ,এই অসুস্থ রিলেশন(আদৌ কি কোনও রিলেশন) থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে যে করেই হোক।
অথচ
তারপরেও আমার যাবতীয় সুখ দুঃখের কথা তোমাকেই বলেছি ।যে সব ইচ্ছেরা মনের গভীরে
লুকিয়ে ছিল,যে গুলো আমার অল্প আয়ে পূরন করতে অক্ষম সেগুলোও তোমাকে দিয়েই সফল
করেছি।তোমাকে একাউন্ট নম্বর জানিয়ে বলেছি, -এক্ষুনি টাকা ভরো ।
তুমি
বিনা বাক্যব্যয়ে সে টাকা জমা করেছ ।আমি তা দিয়ে ফুটপাথের বাচ্চাদের জন্য
বই,জামা,শীতে সোয়েটার কিনেছি।
মাঝে
মাঝে তুমি জিজ্ঞেস করেছ ,-‘কি করো এত টাকা দিয়ে? আমি না থাকলে কে দেবে?’
সে
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলেছি, -‘প্রয়োজন হলে তোমাকেই বলব ,তুমি আর কতদূর যাবে!’
-‘বাঃআমি
রিটেয়্যার করব না? আর তো হই এল।বয়স হচ্ছে তো!’ তুমি বলেছ ।
-‘সেসব
জানি না। অন্য কারোর থেকে চাইব নাকি?’
-‘এটা
দাবী না অধিকার?’
-‘কোনটাই
নয়। যা নিচ্ছি তা আমারই ।তোমার কাছে গচ্ছিত রেখেছি মাত্র’। আমি স্মাইলি পাঠিয়েছি।
এভাবেই
চলছিল। তারপর একদিন তুমি অন্য রকম মজার কথা বললে। প্রাচীন ভাস্কর্যের কথা শোনালে,
খাজুরাহ,অজন্তা,ইলোরা,কোনারক...আমার কৌতুহল হল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাজি
হলাম ।সেদিন তুমি যখন তোমার বন্ধুর হাতে আমায় তুলে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলে তখনও
ভাবিনি কি ঘটতে চলেছে।তার কামনা মেটার পর যখন তুমি এলে,আমি শুধু কেঁদেছিলাম আর
বলেছিলাম, ‘ কি করে তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে?’
তুমি
আমায় বললে , ‘ বোকার মত কেঁদো না।ইটস জাস্ট অ্যা গেম’।
গেম
শেষের পর সেই প্রথম অনুভব করলাম ,আমি তোমাকে,শুধু তোমাকেই ভালবাসি ।যে শরীর ,যে
সুখের কথা তুমি বল তাও ভীষণ ভাবেই তুমি কেন্দ্রিক। অন্য কোনো ছোঁয়াতেই তাতে সাড়া
জাগে না।সেদিন বাড়ি ফিরে কাঁদলাম সারারাত ধরে । বমি করলাম ,খেতেও পারলাম না।
তুমি
জানো আমি বাইরের এই শরীরের পবিত্রতা-অপবিত্রতায় বিশ্বাস করিনা । ওটা পুড়ে গেলে
নেহাতই ছাই-ভস্ম। কিন্তু সেদিন বুঝলাম আমার মন ,আত্মা অপবিত্র হয়ে গেছে নিজের
কাছে।সেদিন আমি যেন নষ্ট হলাম ।
বেশ
কয়েক মাস তোমার সঙ্গে যোগাযোগ না করে নিজেকে নানা কাজে-অকাজে ব্যস্ত রাখলাম।
তারপর
একদিন রাতে তুমি ‘হাই’ বলে টেক্সট করলে ।আমার কান্না এল।মনে হল লিখি ‘এতদিনে আমায়
মনে পড়ল!’ তার বদলে লিখলাম,
-
আমি আর তোমার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চাইনা।
-আমি
তো তোমায় জড়াতে বলিনি’, তুমি লিখলে।
-তা
বলোনি ।কিন্তু আমি মানসিক ভাবে তোমায় আঁকড়ে ধরতে চাইছিলাম’, আমি উত্তর দিলাম।
-আমিও
তাই...’ , তুমি কিছুটা অস্পষ্ট উত্তর দিলে।
সেই
কথাকে বাইপাস করে আমি বললাম ,
-চাই
না কোনো বন্ধনে তোমায় বাঁধতে ।আমাদের এটাই তো কথা ছিল।
-আমি
তোমার উপর কখনও দাবী করিনি ,ভালও বাসব ভাবিনি , তবু তুমি কি ভাবে এসে গেছ
অজান্তেই’ , তুমি লিখলে।
-সেসব
শুধুই সময়ের খেলা।আমার তোমার নিয়তি। তাই তুমি শরীর নিয়েই মগ্ন থেকেছ।আর আমি না
চাইতেই ভালবেসে ফেলে কথা রাখতে পারিনি’। তোমার লেখাকে গুরুত্ব না দিয়ে লিখলাম।
-তাতে
কি?ভালবাসা নানান রঙের হয়। তার সঙ্গে সমস্যা কোথায়?’
-সমস্যা
নেই।কিন্তু ভাল না বেসে শরীর নিয়ে খেলা তো অনেক হল। এবার মন খুঁজি।’
-শুধু
মন আর মন !কত বার মন ছুঁতে গিয়ে বিপদে পড়েছিতুমি জানো না।তবে এই মন এখন তোমায়...’
তোমার লেখায় অন্য আবেগ।
আমার
তীব্র ভাবে তোমায় বলতে ইচ্ছে করল –‘ আদিত্য আই লভ ইউ’।কিন্তু তাকে প্রশ্রয় না দিয়ে
লিখলাম ,
-
কোনো কিছু দিয়েই আর আমাদের কোনো রিলেশন রইল না ।
-না
গেলেই কি নয়! আর একবার ভেবে দেখো প্লিজ...।
সে তীব্র ডাক উপেক্ষা করে মোবাইল অফ করলাম ।
আদিত্য,আমি
হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা ভালবাসার গান শুনেছি।তুমি সে গান ,সে ডাক যদি শুনেও থাকো
,তবু তাতে সাড়া দেবার কোনো দায় নেই তোমার। কিন্তু আমি যতবার চোখ বুজেছি ততবার
তোমায় দেখেছি।তাই আর নতুন ভাবে জড়াতে চাইনা। শুধু তুমি ভালো থেকো।।
বিতস্তা ঘোষাল