চিন্তার ভাঁজ
সকালে
কাগজওয়ালা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ' পেপার --' বলে চিৎকার করে কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে গেল । আমি মেঝে থেকে সেটাকে উদ্ধার করে
বারান্দার চেয়ারে বসে খবর গিলতে শুরু করলাম । এমন সময় রান্না ঘর থেকে বৌ বাজখাই
গলায় চিৎকার করে বললো , '' সকাল থেকে পেপারে মুখ গুঁজে বসে
পড়লে । বলি বাজার কে যাবে ? '' কালই দোকান থেকে নতুন চশমাটা
নিয়ে এসে আজ সেটার বোইনি করেছি । চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে পেপার পড়ার মজাটা তারিয়ে
তারিয়ে উপভোগ করছিলাম, বিগত কয়দিন ঝাপসা দেখার কারণে কাগজ
মুখো হইনি । কিন্তু আমার উপভোগে ছাই পড়লো । বাধ্য স্বামী, তাই
কিছু না বলে কাগজটাকে স্বযত্নে ভাঁজ করে টেবিলের
উপর রেখে চুপিচুপি বৌয়ের কাছে গিয়ে বললাম , '' না মানে একটু
পরে গেলে হতো না কি ? '' বৌ ততক্ষণে একটু প্রেমময়ী হয়েছে ।
ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি এঁকে বললো, '' না গো !'' অগত্যা
বাজারের থলে হাতে সাইকেল ঠেলে আমি বেরিয়ে পড়লাম ।
বাজারে
ঢোকার মুখে পান্তার চায়ের দোকান , পান্তা পোড়া দুধের চা
মন্দ বানায় না । বাজার করার আগে এক কাপ চা আমি রোজের বরাদ্দ করে নিয়েছি । সাইকেলটা
দোকানের খুঁটিতে ঠেসিয়ে বললাম , '' কইরে পান্তা , বরাদ্দ দিয়ে যা । '' পান্তা বরাদ্দ নিয়ে এলো ,
আমিও একটা বেঞ্চিতে বসে বরাদ্দের দফারফা করতে শুরু করলাম । হঠাৎ
হ্যাংলা এসে আমার পাশটাতে বসলো । ও যে কোথায় থাকে কে জানে , আমাকে
দেখলেই কোথা থেকে এসে টুপ করে আমার পাশটিতে বসে পড়ে । কাজেই বরাদ্দ বেড়ে দুই । তবে
আমি এতে বিরক্ত হই না বরং হ্যাংলার হ্যাংলামি শুনতে ভালোই লাগে । রোজ একটা করে
অবান্তর চিন্তা নিয়ে হাজির হয় আর আমাকে বলে সমাধান করে দিতে । ওর একটা চিন্তারও
এযাবৎ সমাধান করতে পেরেছি বলে আমার মনে পড়ে না । তবুও ও রোজ আশা নিয়ে এসে বিফল হয়
। হয়তো ওরও এটাই ভালো লাগে । বরাদ্দতে চুমুক দিয়ে হ্যাংলা বললো , '' দাদা আজ একটা চিন্তা এসে হাজির হয়েছে , তোমাকে
সমাধান করতে হবে । '' আমি বললাম , '' এ
আবার নতুন কি ! রোজকার ঘটনা , বলে ফেল শীগ্গির । ''
'' দাদা আজ সকালে মুখ ধুতে গিয়ে ভাবলাম বাঘও তো খাবার খায় তাহলে ব্রাশ করে দাঁত
মাজে না কেন ? ''
আমি ওর
চিন্তা শুনে মাথা চুলকে বললাম , '' ভাই তোর বৌদি আজ খুব রেগে আছে ,
তাড়াতাড়ি বাজার নিয়ে ফিরতে হবে । '' তড়িঘড়ি
বেঞ্চি ছেড়ে উঠে আমি পান্তাকে দুটো বরাদ্দের দাম দিয়ে বললাম , '' ভাই সাইকেলটা রইলো, আমি বাজার নিয়ে এসে ওটা নিয়ে
যাবো । '' আমি বাজারের দিকে হনহন করে এগোবার মুড নিয়েছি ওমনি
হ্যাংলা পিছন থেকে বলে উঠল , '' এটা আর এমন কি ! রোজকার
ঘটনা দাদা । '' আমি পিছন ফিরে একবার হ্যাংলার মুখের দিকে
তাকিয়ে দেখলাম তখনও ওর মুখে অবান্তর চিন্তার ভাঁজ । কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতের
স্পর্শে আমি অনুভব করলাম আমারও কপালে কয়েকটা ভাঁজ , হয়তো
ওগুলোও হ্যাংলার অবান্তর চিন্তার ভাগ নেওয়ার ফল । ইচ্ছা না থাকলেও অজান্তেই হয়তো
ভাগীদার হয়ে গেছি । না ! আর নয় বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে , ওদিকে
বৌয়ের রণংদেহী মূর্তিটাও চোখে ভেসে উঠছে ।
বাজার
সেরে বাড়ি ঢুকতে যাবো ওমনি হোঁচট খেলাম , বৌ একটা লাঠি হাতে দরজায়
দাঁড়িয়ে । আমার তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত , একবার লাঠিটার দিকে
তাকাচ্ছি একবার বৌয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি । বৌ কিন্তু লাঠি উঁচিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে
নিশ্চুপ । আমার কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে তা স্পষ্ট অনুভব
করতে পারছি । আমি বুকে সাহস নিয়ে বৌয়ের
দিকে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম , '' কি গো হঠাৎ এমন
মূর্তি । '' বৌ খানিক বিরক্ত কন্ঠে বললো , '' আজ শেষ করেই ছাড়বো ! '' আমি ভাবলাম বুঝি দেরি হওয়ার
কারনেই আমাকেই বোধ হয় । তাই বিদুৎ গতিতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম । বৌ দেখে বলল ,
'' তোমার আবার কি হলো ? '' আমি
পুনরায় ভয়ে ভয়ে বললাম, '' কাকে শেষ করবে গো ? ''
'' আরে পাশের বাড়ির বিড়ালটা সকাল থেকে রান্না ঘরে ঢুকছে , তাই ওটাকেই শেষ করবো । কখন কিসে মুখ দেবে তার ঠিক নেই । ''
যাক
বাবা অন্তত আমাকে নয় এই ভেবে একটু স্বস্তি পেলাম । বাজারের থলেটা নামিয়েই কাগজ
মুখি হলাম । হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলো , বড় বড় করে লেখা ,
'' আমাদের অসুধ সেবনে কপালে চিন্তার ভাঁজ দূর হবে ১০০% গ্যারান্টি ।
'' আমি মনে মনে হেসে ভাবলাম , কাল
বাজারে গেলে ওই অবান্তর চিন্তাকারী হ্যাংলাকে এই বিজ্ঞাপনটা দিয়ে আসবো , তাহলে যদি ওর থেকে ভাগ নেওয়া চিন্তার ভাঁজ আমার অদৃশ্য হয় ।
চিন্ময় মহান্তী