সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

চিন্ময় মহান্তী




 চিন্তার ভাঁজ




সকালে কাগজওয়ালা এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ' পেপার --' বলে চিৎকার করে কাগজটা ছুঁড়ে দিয়ে গেল । আমি মেঝে থেকে সেটাকে উদ্ধার করে বারান্দার চেয়ারে বসে খবর গিলতে শুরু করলাম । এমন সময় রান্না ঘর থেকে বৌ বাজখাই গলায় চিৎকার করে বললো , '' সকাল থেকে পেপারে মুখ গুঁজে বসে পড়লে । বলি বাজার কে যাবে ? '' কালই দোকান থেকে নতুন চশমাটা নিয়ে এসে আজ সেটার বোইনি করেছি । চশমার ভেতর দিয়ে তাকিয়ে পেপার পড়ার মজাটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলাম, বিগত কয়দিন ঝাপসা দেখার কারণে কাগজ মুখো হইনি । কিন্তু আমার উপভোগে ছাই পড়লো । বাধ্য স্বামী, তাই কিছু  না বলে কাগজটাকে স্বযত্নে ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে চুপিচুপি বৌয়ের কাছে গিয়ে বললাম , '' না মানে একটু পরে গেলে হতো না কি ? '' বৌ ততক্ষণে একটু প্রেমময়ী হয়েছে । ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি এঁকে বললো, '' না গো !''  অগত্যা বাজারের থলে হাতে সাইকেল ঠেলে আমি বেরিয়ে পড়লাম ।

            বাজারে ঢোকার মুখে পান্তার চায়ের দোকান , পান্তা পোড়া দুধের  চা মন্দ বানায় না । বাজার করার আগে এক কাপ চা আমি রোজের বরাদ্দ করে নিয়েছি । সাইকেলটা দোকানের খুঁটিতে ঠেসিয়ে বললাম , '' কইরে পান্তা , বরাদ্দ দিয়ে যা । '' পান্তা বরাদ্দ নিয়ে এলো , আমিও একটা বেঞ্চিতে বসে বরাদ্দের দফারফা করতে শুরু করলাম । হঠাৎ হ্যাংলা এসে আমার পাশটাতে বসলো । ও যে কোথায় থাকে কে জানে , আমাকে দেখলেই কোথা থেকে এসে টুপ করে আমার পাশটিতে বসে পড়ে । কাজেই বরাদ্দ বেড়ে দুই । তবে আমি এতে বিরক্ত হই না বরং হ্যাংলার হ্যাংলামি শুনতে ভালোই লাগে । রোজ একটা করে অবান্তর চিন্তা নিয়ে হাজির হয় আর আমাকে বলে সমাধান করে দিতে । ওর একটা চিন্তারও এযাবৎ সমাধান করতে পেরেছি বলে আমার মনে পড়ে না । তবুও ও রোজ আশা নিয়ে এসে বিফল হয় । হয়তো ওরও এটাই ভালো লাগে । বরাদ্দতে চুমুক দিয়ে হ্যাংলা বললো , '' দাদা আজ একটা চিন্তা এসে হাজির হয়েছে , তোমাকে সমাধান করতে হবে । '' আমি বললাম , '' এ আবার নতুন কি ! রোজকার ঘটনা , বলে ফেল শীগ্গির । '' 
'' দাদা আজ সকালে মুখ ধুতে গিয়ে ভাবলাম বাঘও তো খাবার খায় তাহলে ব্রাশ করে দাঁত মাজে না কেন ? '' 
আমি ওর চিন্তা শুনে মাথা চুলকে বললাম , '' ভাই তোর বৌদি আজ খুব রেগে আছে , তাড়াতাড়ি বাজার নিয়ে ফিরতে হবে । ''  তড়িঘড়ি বেঞ্চি ছেড়ে উঠে আমি পান্তাকে দুটো বরাদ্দের দাম দিয়ে বললাম , '' ভাই সাইকেলটা রইলো, আমি বাজার নিয়ে এসে ওটা নিয়ে যাবো । '' আমি বাজারের দিকে হনহন করে এগোবার মুড নিয়েছি ওমনি হ্যাংলা পিছন থেকে বলে উঠল , '' এটা আর এমন কি !  রোজকার ঘটনা দাদা । '' আমি পিছন ফিরে একবার হ্যাংলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তখনও ওর মুখে অবান্তর চিন্তার ভাঁজ । কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতের স্পর্শে আমি অনুভব করলাম আমারও কপালে কয়েকটা ভাঁজ , হয়তো ওগুলোও হ্যাংলার অবান্তর চিন্তার ভাগ নেওয়ার ফল । ইচ্ছা না থাকলেও অজান্তেই হয়তো ভাগীদার হয়ে গেছি । না ! আর নয় বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে ,  ওদিকে বৌয়ের রণংদেহী মূর্তিটাও চোখে ভেসে উঠছে । 

               বাজার সেরে বাড়ি ঢুকতে যাবো ওমনি হোঁচট খেলাম , বৌ একটা লাঠি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে । আমার তখন প্রাণ ওষ্ঠাগত , একবার লাঠিটার দিকে তাকাচ্ছি একবার বৌয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি । বৌ কিন্তু লাঠি উঁচিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ । আমার কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে তা স্পষ্ট  অনুভব করতে পারছি ।  আমি বুকে সাহস নিয়ে বৌয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বললাম , '' কি গো হঠাৎ এমন মূর্তি । '' বৌ খানিক বিরক্ত কন্ঠে বললো , '' আজ শেষ করেই ছাড়বো ! '' আমি ভাবলাম বুঝি দেরি হওয়ার কারনেই আমাকেই বোধ হয় । তাই বিদুৎ গতিতে কয়েক পা পিছিয়ে গেলাম । বৌ দেখে বলল , '' তোমার আবার কি হলো ? '' আমি পুনরায় ভয়ে ভয়ে বললাম, '' কাকে শেষ করবে গো ? '' 
'' আরে পাশের বাড়ির বিড়ালটা সকাল থেকে রান্না ঘরে ঢুকছে , তাই ওটাকেই শেষ করবো । কখন কিসে মুখ দেবে তার ঠিক নেই । ''  
যাক বাবা অন্তত আমাকে নয় এই ভেবে একটু স্বস্তি পেলাম । বাজারের থলেটা নামিয়েই কাগজ মুখি হলাম । হঠাৎ একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেলো , বড় বড় করে লেখা , '' আমাদের অসুধ সেবনে কপালে চিন্তার ভাঁজ দূর হবে ১০০% গ্যারান্টি । '' আমি মনে মনে হেসে ভাবলাম , কাল বাজারে গেলে ওই অবান্তর চিন্তাকারী হ্যাংলাকে এই বিজ্ঞাপনটা দিয়ে আসবো , তাহলে যদি ওর থেকে ভাগ নেওয়া চিন্তার ভাঁজ আমার অদৃশ্য হয় ।




 চিন্ময় মহান্তী