বাউল বাতাস
“অ খুড়ো চললা কোথা?”
উত্তর না দিয়ে
গঙ্গাপদ একই তালে হাঁটতে থাকে। চৈতালি হাওয়ায় কাঁচাপাকা চুলদাড়ি তালে তালে নেচে
ওঠে। বুড়ো বেবাক ভুলো চোখে আকাশ দেখতে দেখতে হাঁটে।
জোয়ান হারাধন আর
সহ্য করতে পারে না। গতরের পেশী ফুলিয়ে হাঁক পাড়ে, “বলি অ খুড়ো! খু- ড়ো-ও!”
হাঁকের ঠেলায়
গঙ্গাপদর বেভুল চোখে দৃষ্টি ফেরে। তারপরই হারাধনকে দেখে তেড়ে ওঠে, “মর হারামজাদা!
চিল্লাও ক্যানে? মুই কী কালা! মরণ কোতাকার!”
“কালা না তো কি!
আকাশপানে চেয়ে এমন বাউল হয়ে যাও কোথা? বলি, বয়সের তো গাচপাতর নাই! সারাদিন কী ভাব
তা কে জানে!”
পাগলা গঙ্গাপদ এবার
রেগে একপাক ঘুরে বলে, “তোমার মাতা! বলদ কোতাকার! তা ধম্মের ষাঁড়, ঘুরি ঘুরি বেড়াও,
যাও না ক্যানে ক্ষেতে! তোমার বাপ মুকে অক্ত তুলে খেটে মরে, হাত লাগাতি পার না!”
খ্যাঁক খ্যাঁক করে
হাসে হারা। বলে, “সাদে কি কালা বলি খুড়ো! এই দ্যাকো না, পালা গেয়ে ফিরচি। কাঁদে
হারমনি। আমি যাব ক্ষেত খামারি কত্তে!”
বুড়োর আবার বাউল
মন। বলে, “তা আমায় ক্যানে ডাকলা বল।”
হারার সারা শরীর
নেচে ওঠে। চোখমুখ দেখনাই করে বলে, “বলি খুড়ো, তোমার ঘরে ও ছুকড়ি কে গ? তোমার কোন
পিরিতের মেয়েছেলে?”
হারা অবাক হয়ে দেখে
বুড়ো রাগার বদলে ভুরভুরিয়ে হাসে। শব্দ যত না হয়, গা দোলে বেশি। হারা অবাক হয়ে সে
হাসির তল পায় না। বলে, “হেসে মরচ ক্যানে গ? রঙ্গ দেকে আর বাঁচি না!”
একই তালে হাসতে
হাসতে খুড়ো বলে, “ধর না কেনে, সে আমার পিরিতের নাগরি!”
হারা ভাবে, শালা
বুড়ো, জাতে মাতাল তালে ঠিক। কিছুতেই বলে না! সেও ছাড়ার পাত্র নয়। কোমরের ট্যাঁক
থাকা বিড়ি বার করে খুড়োকে দেয়, নিজেও ধরায়। খুড়োর হাত ধরে টেনে এনে বসায় বটতলায়।
দুপুরবেলা বটতলা ফাঁকা। মাঠে মাঠে মেয়ে বউরা খাবার নিয়ে চলে গেছে। চৈত্রের
হাওয়ামাখা সবুজ ক্ষেতের দিকে চেয়ে গঙ্গাধরের মন আবার বাউল হতে চায়।
এবার হারার কোমল
গলায় ডাকে, “খুড়ো!”
খুড়ো কোন সুদূর
থেকে সারা দেয়, “বল ভাই।”
“ও ছুকড়ি তোমার কে
হয় গ?”
“আমার পাটরানী।”
“কী! পাটরানী?”
“হ্যাঁ রে বলদ!”
“কেমনে?”
“কেমনে কি রে হারামজাদা!
আমার নাতি মেলেটারিতে গে পরান দিল। নাতবৌ পাঁচ মাসের পোয়াতি। আমি তো ছেলে বৌমা সব
খেয়ে বসে আচি। মামার ঘরে লাতিঝাঁটা খাচ্চিল। আমার কাচে নে আলাম।”
হারা স্তম্ভিত, “বল
কি খুড়ো!”
ভুরভুরে হাসি
থামিয়ে গঙ্গাপদ আবার আকাশপানে চায়। হারাধন টেরিয়ে দেখে খুড়োর দু চোখে দুটি
মুক্তদানা
সোমা রায়