অসুখ
সাতদিন পর পর ফিরে এসে কাঁহাতক কাঁপুনি মাকড়সার
ট্রাপিজের খেলা সহ্য করা যায়! একোণ সেকোন, এদিক সেদিক বিশেষ করে রান্নাঘর কিংবা
বাথরুমের কোনগুলোতে নিশ্চিন্তিতে দেদার সরু দুবলা ছ ঠ্যাং তুলে কাঁপতে থাকা ওদের
দেখলে শবরীর ঘিন ঘিন তো করেই কেমন ভয় সংকোচে বুকের অন্দরমহল শুকিয়ে যায়। এই শুকোনো
ভাবটা এক্কেবারে প্রিয়জনের অসুস্থ বিছানার পাশে এলে শবরী অনুভব করেছে সেই
ছোট্টবেলা থেকে। এটা কি কোন অসুখ!বোধহয়। আর ঠিক এই সঙ্কুচিত বোধটা চাগার দেয় বলেই
আত্মীয়স্বজন, ভাই, স্বজন প্রায় সকলের কাছেই শবরী স্বার্থপর, নিজেরটা শুধু বুঝে চলা সেলফিশ
জায়ান্ট। এমনকি এখন ছেলে মেয়েরও সেই ধারনা মনে মনে হয়তোবা। অথচ অনেকদূরের
অনাত্মীয়, অল্প পরিচিতদের সেবায় এগিয়ে যায় বলে শবরীর বাইরে বেশ নাম ডাক। সে নিজে
উপস্থিত থেকে হোক বা অর্থ সাহায্য দিয়ে হোক সব ব্যাপারে এক নম্বর।...কিন্তু এ
অসুখতো মারাত্মক! এ রোগ প্রথম নিজের ভেতর আবিষ্কার করেছিল বয়স যখন ন দশ। একমাত্র
প্রিয়জন বাবা মাঝে মধ্যে অ্যাসিডে আক্রান্ত হতেন। আর গ্যাস ফর্ম করে বুক জ্বলে যেত
তাঁর । ওষুধ
খেয়েও কমতনা। মাথা ঘুরে প্রায়ই পড়ে যেতেন। একদিন তো ওমনি রাত দশটা সাড়ে দশটা,ঝন ঝন
আওয়াজ। বিরাট কিছু পড়ে গেল, পাশের ঘরে সবে অঙ্ক শেষ করে ঝিমুনি এসেছে চোখে...শব্দ
আর চিৎকারের আওয়াজে ছুটে গেল সে। কিন্তু ঐ যে থমকে দাঁড়িয়ে পড়া...সে এখনও চলছে সমানে।
বাবা ছোট কাঠের আলমারীটায় ভর দিয়ে নিজের শরীরটা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন পারেননি। আলমারীটা
প্রচন্ড ধাক্কায় হেলে গেছে,মাথার উপর যত জিনিস পত্র সব নীচে পড়েছে আর বাবার মুখে
তীব্র যন্ত্রণা বুক পেট চেপে ধরেছেন। শবরী শুকিয়ে যাচ্ছে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। পা দুটো
কে যেন মাটির সঙ্গে গেঁথে দিয়েছে। জেঠতুতো দাদা দিদি মা জেঠিমা সবাই মিলে প্রথমিক
চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ডক্টর ব্যানার্জিকে কল দিয়েছেন। বাবা খানিকটা সুস্থবোধ
করছেন, বিছানায় বালিশে মাথা দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছেন। ঘরে আপাতত কেউ নেই, মা মাঝে মাঝে
আসছেন দেখে শুনে ওষুধ খাইয়ে চলে যাচ্ছেন, বাবা স্তিমিত নিমীলিত চোখে শবরীকে দরজার
কাছে দাঁড়ানো দেখে দুহাত বাড়িয়েছেন, ডাকছেন, মৃদু হাসছেন। সর্বনাশ! শবরী নড়তেই
পারছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে...বাবার কষ্টটা ওর ভেতরে ঢুকে গিয়ে চরম নিদারুণ এক
রাসায়নিক ক্রিয়ায় ওর মানবিক বোধগুলোকে বিপর্যস্ত করে শক্ত পাথরে পরিনত করেছে। চেষ্টা করছে বাবার কাছে যেতে, প্রয়োজন বোধ
করছে, কিন্তু তীব্র সঙ্কোচ ওকে কুরে খাচ্ছে। কি করবে ও এখন!....সেই প্রথম আবিষ্কার করেছে এ
অসুখ। এভাবেই মায়ের তীব্র যন্ত্রণা, পা ভেঙে গিয়ে শয্যাশায়ী, সে অবস্থাতেও দূর থেকে
শুধু এক একবার দেখেছে সামনে গিয়ে একটু স্পর্শ দেওয়া এটা পারেনি। বুকের কষ্ট বেড়েছে। কেউ জানেনা এইযে ও এগোতে পারছেনা তার জন্য
যন্ত্রণার পোকাগুলো ওকে ছিঁড়ে ফেলেছে ভেতরে ভেতরে। এ অসুখতো ওর হওয়ার কথা ছিলনা। ছোট্টবেলা থেকে রুগ্ন মেয়েটার অসম্ভব যত্ন
প্রয়োজন ছিল। মা
করেছেন। টাইফয়েড,জলবসন্ত, জ্বর, পেটখারাপ
সবেতে বাবা নাহলে মা এপাশে ওপাশে। আর যৌথবাড়ীর সকলেরই মনোযোগ পাওয়া মেয়ের তো এ স্বভাব হওয়া উচিত
না। কিন্তু
হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে
বাবা মা বা পরে অনিমেষের অসুখ সবটা নিজের ভেতর নিয়ে অসহ্য বিপদ বিমুখ স্বার্থপর নাম পেয়েছে। আর এখন কর্মসূত্রে সেই দুকামরা একলা ঘরে
স্বাচ্ছন্দবোধ তৈরি হলেও অসুখটা দানা বাঁধে। ঝুলমাখা খাতা বই অপরিচ্ছন্ন জামাকাপড় কিংবা
দেয়ালের একোণ সেকোণে জমে থাকা মাকড়সার দল সবতো নিজে হাতেই পরিষ্কার করতে হয়, কিন্তু
বুকের ভেতর সেই অন্যরকম অস্তিত্ত্বটা টের পায়।
আজও ঠিক ওমনি দুটো বাসের একটা বাস যন্ত্র বিগড়ে, টায়ারপাংচারে, ড্রাইভারের পাশের ঢাকা যন্ত্রের গরম হয়ে ওঠা বনেটের পাশ থেকে প্রায়
দৌড়ে বেরিয়ে এসেছিল শবরী। ওর সঙ্গে ওরমত আর এক মেয়েও বাসে ছিল। সেও খানিক অসহায় শবরীকে সঙ্গে নিয়ে ওর হাতের তিনখানা ব্যাগের দুটো
ব্যাগ হাতে নিয়ে ছুটে আর এক স্টেটবাস দাঁড় করিয়ে শবরীকে প্রায় হাত ধরে সিটে বসিয়ে
দেয়। পরে চিনতে পারে,আরে এত সুমনা,ওর ছাত্রী ছিল বেশ কবছর আগে।শবরী মধ্য
পঞ্চাশের প্রৌঢ়া হলেও দৌড় ঝাঁপে ত্রিশ। তবু
এই পুরোনো ছাত্রীর যত্ন ওর বুকের ভেতরটা নেড়ে চেড়ে দেখে নেয়।...আচ্ছা, আমি এরকম
কারো জন্য ..দৌড়ে সময় নষ্ট করে সুবিধা করে দিতাম! শবরীর
নিজের মধ্যে টের পায় আবার সঙ্কোচন প্রসারণ।
মিসেস শবরী মিত্র তাঁর ক্লাসের সব মেয়ের মুখ দেখে বলে দিতে পারে
তারা মন দিচ্ছে কিনা, খেয়ে এসেছে কিনা, বাড়ীতে কার মা বাবা কিরকম আচরণ করে সব মুখস্থ
বলে দিতে পারে। নিমেষে ওদের পরম নির্ভরতার জায়গা তৈরি হয় শবরী ম্যামকে ঘিরে। আর এ কাজ সত্যিই শবরী স্পর্শ আর অনুভব দিয়েই করে। শুধু পড়াশুনো করানো যে শিক্ষকতার ধর্ম নয় সেটাও উপলব্ধি করে কিন্তু
ওর অসুখটা তীব্র হয় একান্ত আপন জনদের ক্ষেত্রে, এবড় অদ্ভুত!
সন্ধে রাত। ভাইয়ের নাক দিয়ে গলগল
করে রক্ত বেরোচ্ছে শবরীর ভেতর সেই শুকিয়ে আসা অসুখ তীব্র। মা পাগলের
মত জল টানাচ্ছেন নাকের কাছে হাতের আঁজলায়, অনেকটা টানার পর বালিশে গলা উঁচু করে
মাথা ঠেকিয়ে রাখে...এভাবে যে কতদিন ভয় চোখে দূরে দাঁড়িয়ে এ রক্তঝরা দেখেছে, আর মা
যা যা চেয়েছেন যন্ত্রের মত এটা ওটা এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু না, কিছুতেই
একেবারে আগলে নিয়ে সেবকা বনে গিয়ে রক্ত মুছে দেওয়া সেটা পারেনি। পিছনে ঐ যে বিশ্রী যখন ছেলে মেয়ের পালা, ছোট্টবেলা, আগলে রাখার
প্রবৃত্তিটা হয়ে উঠেছিল প্রবল। ছোট্ট থেকে নিজে যেমন
রেখে ঢেকে আদুরেপনায় আর শাসন তর্জনে বড় হয়েছে ওদের ছোটবেলাটায় সেইমত করতে গিয়ে বহু
পরিশ্রম করে ফেলেছে একালের একান্ত অত্যুৎসাহী অভিভাবকদের মত। আর মাথায় কাজ ও করেছে...না, ওরা যেন অসুস্থ না হয়,তাহলে আবার যদি
শবরীর ভিতরের অসুখটা মাথা চাড়া দেয় তাহলে কচিগুলোকে দেখবে কে ,কার হাতে ছাড়বে! পাশাপাশি অনিমেষকেও ঠিক অ্যাফেকশনেট বলা যাবেনা সে অর্থে। শুধু একথা
সেকথার তোড়ে দায়িত্ব কর্তব্য করে,তাতেও উদাসীনতায় ত্রুটি বিচ্যুতি আর শবরীর শূন্যতাবোধ
ঘিরে থাকে, ফলে এদের কাছে মা হিসেবে দায়িত্ব বাড়িয়ে ফেলে নিজেই। তাতে অসুখের
মাত্রাটা কিছুটা হলেও কম থাকে। তবুতো ছেলে মেয়ে দুষ্টুমীর খেলায়, ছেলের দুরন্তপনার
জেরে অনেকবার এই অসুখ বোধ নিয়েই ঝাঁপাতে হয়েছে শবরীকে, নয়তো মরে যেত যে ওরা! ছেলের ছ
সাতমাস বয়স কি একবছরের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সারা মেঝেময় ঘুর ঘুর আর পাকা সিমেন্ট
ডেটোয় লেগে থুতনি ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্তধারা, ঐ অসুখ ওলা মাই একমুঠো চিনি হাতে প্রথম
সামাল দিতে চেষ্টা করেছে। আবার ছুটতে ছুটতে রিক্সা ধরে সোজা হাসপাতাল। স্টিচ করিয়ে তারপর নিস্তার। বুকের
ভেতর কষ্টটা দানা পাকাচ্ছিল বার বার। প্রায়ই শিশু
বিশেষজ্ঞের কাছে মেয়েকেও নিয়ে গেছে, ছেলেকেও। মানথ্লি চেক আপ। তারপর বুষ্টার
ডোজ,ইঞ্জেকশন, ওষুধ পোলিও নিরাময় কোর্সে নিয়ে যাওয়া এসবতো লাগাতার। সব সত্ত্বেও
বুষ্টারডোজ নিতে ইঞ্জেকশন দিতে গিয়ে অনিমেষ শবরীর অক্ষমতার কথা আর তীব্র অসুখের
নাগাল পেয়েছিল বলে শবরী কানে দু আঙুল চাপা দিয়ে ডাক্তার চেম্বারের বাইরে
হাঁটাহাঁটি করত। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ যখন থেমে যেত, ইঞ্জেকশনের প্রথম ধক যখন শান্ত
হত তখন দরজা দিয়ে উঁকি দিত শবরী। কোলে নিত, জড়িয়ে ধরে চোখে জল মোছাত। এসব সময়
অনিমেষ ভগবান শবরীর কাছে।
ওরা ঝাড়া হাত পা নিয়ে একা একাই কখন যেন এক একটি আলাদা মানুষ হয়ে
উঠল,তবু তো জ্বর ,ব্যধি,পেট ব্যথার কাতরানি এসবতো আছে।শবরীর মনে আছে,নিজের যখন
জ্বর হত, ফুঁপিয়ে কাঁদত।এখনও কাঁদে এখন আরও বেশীরকম। বুকের ভিতর একা হওয়ার দু:খে
কাঁদে জ্বর হলে। কিন্তু ও নিজেতো মেয়ে বা ছেলের জ্বর হলে এক আধবার কাছে যাওয়ার
তীব্র চেষ্টা করেছে, গেছে। ছুঁয়েওছে কিন্তু ভেতরের সেই সঙ্কোচন অসুখটা মাথাচাড়া
দিয়েছে।শবরী দূরে রান্নাঘরের অছিলায় দুধ গরমের অজুহাতে অথবা অন্য কাজের বাহানায়
উঠে এসেছে। মেয়ের পেটের তীব্র যন্ত্রণায় হয়তো হট ব্যাগখানা সুইচে লাগিয়ে ওর হাতে
ধরিয়ে সরে এসেছে।বরং অনিমেষ বার কয়েক খোঁজ নিয়ে কাছে বসে ব্যথা সংক্রান্ত খবর
নিয়েছে। ঠিক একই ভাবে ছেলের তীব্র শ্বাসকষ্টে বুক ডলে দিয়েছে সারারাত জেগে
অনিমেষ।শবরী পাশে শুয়ে দুচোখের পাতা এক করতে না পারা এক অন্যরকম অসুখে ভুগেছে
যেটা ওর খুব চেনা অসুখ। যার ওষুধ বা চিকিৎসা বের হয়নি,হয়তো এখনকার ঠিক এই মুহূর্তে
কোন সাইক্রিয়াটিষ্টের কাছে গেলে তিনি কেস হিষ্ট্রি জেনে সমাধান দিতে পারতেন।
শবরী কখনও যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি।ওই অসুখ নিয়েই দিব্যি কাটিয়ে
দিল ত্রিশ বছর। একত্র সংসারে আসলে সহিষ্ণুতায় অনিমেষ বুঝি শবরীর চেয়ে এগিয়ে আছে
কয়েক ধাপ ।
একা শবরীকে অনেক কাজ করতে হয়। অন্তত
খাওয়া বাসন মাজা এটুকুতো করতেই হবে একজনের জন্য কাজের লোকের পিছনে অর্থদন্ড দিতে
ইচ্ছে করেনা দু কামরার ফ্ল্যাটটার ভাড়া গুণতে হয় একার জন্য সেটাই বিরক্তির। তবে টাকা বেশী নিলেও এ ফ্ল্যাট শবরীর নিশ্চিন্ত আরামের। লাইটের মেরামত কিংবা জলের সমস্যা হলে বাড়িওলা তৎপর। এ চরাচর শহুরে
এলাকায় দেখা যায়না। বাড়িওলার বাড়ী দূর হলেও ফোনেই কাজ সারতে হয় ফ্ল্যাট
বাসিন্দাদের।তৎপর থাকেন এসবে তিনি। লোক রেখে দিয়েছেন। দুদিন ঘর ঝাঁট দিতে ইচ্ছে
করেনি। কোমরের ব্যথাটা বেড়েছে। সম্ভবত এবড়ো খেবড়ো ভাঙাচোরা রাস্তায় টোটো
চড়ে যাতায়াতের ফল। সকাল দশটার ক্লাস ধরতে হলে এছাড়া তো আর পদব্রজ কথাটি
খাটেনা। সুতরাং ব্যথায় ভোগো।
এখানকার খবরাখবর নিতে ছেলে মেয়ে নিজে থেকে খুব একটা ফোন টোন করেনা। বর্তমান প্রজন্মের আবেগ আকুলতার দুর্বলতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে
নিতে অনেক কিছুই শেখানো যায়নি বলে আপশোস করে শবরী, মাঝে মধ্যে অনিমেষ আর ও প্রৌঢ়
পড়ন্ত আলোয় আলাপ আলোচনার ফাঁকে এ সিদ্ধান্তে এসেছে অনেকবার ছেলেমেয়ের উপর ভরসা
একেবারেনা। ওরা অন্যরকম। অনিমেষ বলে,তুমিই ওদের
এখনকার আচরণে ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে। তোমাকে নিয়েই ভয়। অন্যদিকে শবরী ভাবে,এ লোক এখনই
ওদের এই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড কনসেপ্ট মেনে নিতে পারছেনা, একি
করে পরিবারে অন্যরকম মানুষ, অস্তিত্ত্ব সহ্য করবে! স্বপ্নপুরুষ আর অপূর্ব বনলতা সেন তো আর মেয়ে আর ছেলের জন্য কেউ
হাতে নিয়ে বসে নেই! আর দিলেও তারা সেটা মেনে নেবেই বা কেন! নিজেদের পছন্দই গুরুত্ব পাবে এ পরিবারে। আর
দুজনেই বহু বহু স্বপ্নের সমাধি দিয়ে বুকের ভিতর গড়ে নেবে কষ্টের সৌধ। ওরা থাকবে
ওদের মত বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। তাও আলাদা পছন্দে আলাদা রকমে।
ঠিক এই মুহূর্তে ছ ঠ্যাঙের মাকড়সার তিরতিরিনি কাঁপন অজস্র জলধারায়
ঝাপটে কমেছে। চোখে দেখা যাচ্ছেনা নিশ্চয়ই মরেছে। এখুনি এই সন্ধে রাতেই ঘর
ঝেঁটিয়ে নিতে হবে। পুজোর বন্ধে টানা একমাস ঘর থাকবে তালাবন্দী। খোলার পরের তীব্র
ধূলোর গন্ধটা আর ও একবার শ্বাসকষ্ট বাড়ায় শবরীর।
গভীর রাত।শবরীর রাত জাগার অভ্যেসটা ছাড়তে হয়েছে শারীরিক কিছু
অসুবিধের জন্য। আর একা হওয়ার কতগুলো অসুবিধেতো আছেই। হয়তো
বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছে, না হলো রাতের খাওয়াটুকু, পড়ে
থাকলো খোলা চুল, ওদিকে যখন ঘুম ভাঙল ভোর রাত-কি কোন কোনদিন ভোরই হয়ে গেছে, পাখি ডাকছে। আজ আর তেমন কোন ব্যাপার
নেই। ঘরের ঝুল বই খাতা সরিয়ে খবর কাগজগুলো আলাদা করে বিক্রির জন্য
একসঙ্গে করে দুটো বড় ঘর ঝেড়ে মুছৈ নিজে গা ধুয়ে শুতে প্রায় আড়াইটা। শুয়ে শুয়ে অজস্র অতীত আর বর্তমানের টুকরো ছবির সংযোগ স্থাপনের
চেষ্টা করে করে কখন দুচোখ এক হয়ে গেছে! ঘুম
ভাঙল যখন বুকে কিরকম পাথর চাপা কষ্ট। শবরী বোঝে ধূলো
এলার্জি। হাত বাড়িয়ে আলোর সুইচ জ্বালতে যায়।হাতে টান ধরে। কেমন আঙুলগুলো খিঁচ
ধরে আছে। বাঁকাত হতে গিয়ে শিরদাঁড়ায় টান লাগে, উঠতে
পারছেনা শবরী। ডানহাতের নাগালেই মোবাইলটা আছে। অন্ধকারে সুইচ জ্বালালেই ডিজিটগুলো
উঠে আসবে চোখের সামনে। অনিমেষকে জানানো খুব দরকার। যদিও শুনে এতরাতে ও কিছু করতে পারবেনা, সকালেন রওনা দিলেও আসতে আসতে দুপুর। ততক্ষণ শবরী যদি...আর ভাবতে পারেনা। কেমন
ভয় বাসা করতে থাকে, একটুখানি সামাল দিয়ে মেয়ের নম্বরে আঙুল চলে যায়, পরক্ষণেই
থামে। নিজের কথা, নিজের বুকের সেই শুকিয়ে ওঠা সংকোচনের অসুখটার কথা মনে হয়। মেয়ের ওতো
ঠিক ওর মতই হতে পারে। আর ছেলেতো সাগরপারে। ওকে জানানোর প্রশ্ন নেই। জানানোর মত এখনও কিছু ঘটেনি। ইনহেলারের
ব্যাগ হাতড়াচ্ছে এ মুহূর্তে শবরী। বুকের চাপ ধরা যন্ত্রণা
আর সেই ছেলেবেলা থেকে বহন করা দরজার কোণে দাঁড়ানো সংকোচন আর ভীতির অসুখটা কখন যেন
একাকার হয়ে যায়। শবরী বুঝতে পারে ওর জন্য সকলে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। সংকুচিত মনের তীব্র অসুখের ছবিটা এখন শবরীর আবছা রাতের দেয়ালে বিরাট
ছায়া মেলেছে। ও নিজেও আধখোলা দরজার আলোটুকুর দিকে চেয়ে মার অস্পষ্ট ছায়া শরীর
দেখতে পায়, একমাত্র মাই চেষ্টা করে যাচ্ছে ঐ দরজার সীমা রেখা ঠেলে সরিয়ে শবরীকে
ছোঁয়ার। শবরী আকুল আগ্রহে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।
মণিদীপা
নন্দী বিশ্বাস