জসীমউদ্দীন ও তাঁর দুটি আখ্যানকাব্য
প্রবন্ধে সাগর বিশ্বাস
কবি
জসীমউদ্দীনের আখ্যান কাব্যগুলির মধ্যে ‘নকসী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ই
সর্বাধিক পরিচিত ও প্রচারিত। বিষয় ভাবনা, ছন্দ প্রয়োগ এবং কবির সমাজ সচেতন
দৃষ্টিভঙ্গির মিল দুটি কাব্যের মধ্যেই অন্তঃসলিলা হয়ে আছে। এমনকী সে মিল যেন তাদের
বহিরঙ্গে নামকরণের অনুপ্রাসিকতাতেও লিপিবদ্ধ। দুটি কাব্যের অন্তরঙ্গ সাদৃশ্য এভাবে
স্পষ্ট করা যায়ঃ
১। কাহিনীঃ দুটি কাব্যই মূলত প্রেমোপাখ্যান।
২। ছন্দঃ দুটি কাব্যেই কবি স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ
ব্যবহার করেছেন।
৩। সমাজ- বাস্তবতাঃ দুটি কাব্যের মধ্যেই বাঙলাদেশের
গ্রামীন সমাজের বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত যেখানে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, সম্প্রদায়ে
সম্প্রদায়ে প্রগাঢ় সখ্যতার পাশাপাশি অতি তুচ্ছ কারণেই রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটে যেতে
পারে।
এ সংঘাত
নকসী কাঁথায় এসেছে গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, সোজন বাদিয়ায় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে নকসী কাঁথায় সাজু ও রুপাইয়ের প্রণয়- পর্ব লোক নিন্দায় কণ্টকিত
হলেও বিয়ের পরে একটি নিষ্কণ্টক সুখী জীবন তাদের কাম্য ছিল, প্রাপ্যও ছিল। কিন্তু
গ্রাম্য কাজিয়ার আগুন বিপর্যয় নিয়ে এল সে কাঙ্ক্ষিত জীবনে। গ্রামদেশে চাষের অধিকার
আর ফসলের অধিকার অনেক ক্ষেত্রেই সমার্থক হয় না। রুপাইদের গাজনাচরের জমির ধান
‘বনগেঁয়ো’রা কেটে নিলে সংঘাত বাঁধে। এক গ্রামের সঙ্গে আর এক গ্রামের কাজিয়া। এখানে
বিবদমান দুটি দলই মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত। সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু জমি ও ফসল। এ লড়াইয়ে ব্যক্তিগতভাবে রুপাইয়ের অংশ নেওয়া
বাধ্যতামূলক না হলেও পাড়া কিংবা গ্রামীণ ঐক্যের খাতিরে নিতে হয়। কিন্তু পুলিশের
ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় নববধূ সাঁজুর কাছে তার আর্তকণ্ঠ ভেঙে পড়েঃ
“লড়াইয়ে
আজিকে কত মাথা আমি ভাঙিয়েছে দুই হাতে,
আগে
বুঝি নাই তোমারো মাথার সিঁদুর ভেঙেছে তাতে”।
এভাবেই ভালোবেসে গড়া এক নবীন
দাম্পত্যজীবনে ট্র্যাজেডির ছায়া নেমে আসে।
সোজন বাদিয়ার এই ট্র্যাজেডি আরও
মর্মস্পর্শী। সেখানে প্রণয়কাহিনী নায়ক নায়িকা ভিন্ন সম্প্রদায়ের। শিমুলতলি গ্রামের
সুনিবিড় শান্ত পরিবেশে পাশাপাশি বাস মুসলমান ও হিন্দু নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত
চাষীদের। সেখানে গদাই নমুর কিশোরী মেয়ে দুলীর সাথে ছমির শেখের ছেলে সোজনের ‘ভারি
ভাব’।
“সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, পথে
যদি দেখা হয়
যেন রাঙা ঘুড়ি আকাশে উড়াল, হেন তার
মনে লয়”।
পাড়াগাঁর লোকনিন্দা এ মেয়েরও পিছু
ছাড়ে না। সে কানাঘুষোর তিতিবিরক্ত মায়ের কণ্ঠে যখন ‘ধাড়ি মেয়ে’, ‘আধেক বয়সী মাগী’
ইত্যাকার শব্দ সহযোগে তীব্র আক্ষেপ উচ্চারিত হয়ঃ
“পোড়ারমুখীলো, তোর জন্যতে পাড়ায় যে
টেকা ভার,
চুন নাহি ধারি এমন লোকেরও কথা হয়
শুনিবার”।
তখনও সে মেয়ে জানে না বয়স
ব্যাপারটা কী, লোকনিন্দাই বা কেন। তাই অপাপবিদ্ধ দুলীর মুখেও অভিমান টগবগিয়ে ওঠেঃ
“কালকে ত আমি যোজনের সাথে খেলতে
গেলাম বনে,
বয়েস হয়েছে একথা ত তুমি বল নাই
তক্ষণে।
একরাতে বুঝি বয়েস বাড়িল? মা তোমার
আমি আর
মাথার উকুন বাছিয়া দিব না, বলে
দিনু এইবার”।
এরকম শান্তোর্মি মুখরিত গ্রাম
জীবনেও সহসা অশান্তির করাল ছায়া নেমে আসে। শিমুলতালি গ্রামে মহরমের উৎসব। এককালে,
গ্রামবাঙলার মহরম শুধু মুসলমানের পরব ছিল না। তার চিত্তাকর্ষক লাঠিখেলায় হিন্দুরাও
সামিল হত। শিমুলতলি গাঁয়ের মেলাতেও যথারীতি হিন্দু পাড়ার নমুরা সামিল। হঠাৎ ‘একটা
কিছু সামান্য কি কারণ লয়ে/নমু মুসলমানের লড়াই বাঁধলো হঠাৎ জমাট হয়ে’। নিহিত কারণ যা ছিল তা হচ্ছে শিমুলতলির সাথে সাউদপাড়ার
খাঁয়েদের এক পুরনো বিবাদের জের। প্রচলিত ভাবাবেগে ভাজনপুরের শেখরা সাউদপাড়ার পক্ষ
নেওয়ার গোলমালটা জোর লেগে যায়। ফল হলঃ
“মুসলমানের উৎসবেতে নমু ছিল অনেক
যে কম,
পরাণপনে খানিক যুঝি মার খাইল সবাই
বেদম”।
নমুদের সাথে শিমুলতলির মুসলমানেরাও
মার খেল। এরপর আমরা দেখি রামনগরের নায়েব মশায় মঞ্চে অবতীর্ণ। সমান্ততান্ত্রিক
সমাজের প্রতিভূ এ লোকটির অনেককালের স্বপ্ন শিমুলতলিতে একটি হাটের পত্তন করা।
কিন্তু গ্রামবাসীর সম্মিলিত প্রতিবাদে তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। এই তো সুযোগ।
সুযোগ ঐক্য ভাঙার, সুযোগ স্বার্থসিদ্ধির। অতএব গর্জে ওঠেন নায়েব মশায়ঃ
“নমুর মাথায় লাগায় বাড়ি, এতই সাহস নেড়ে বুকে,
গোখরো সাপের লেঙুড় ছিড়ে আজো তারা
ঘুমায় সুখে?”
কিন্তু শত প্ররোচনা- এমনকী ধর্মের
সুড়সুড়ি দিয়েও হিন্দু পাড়ার মানুষগুলিকে এককাট্টা করা গেল না। তারা তাদের
প্রতিবেশী, দুঃখসুখের সাথী, নিরপরাধ মুসলমানের উপর নায়েবের হুকুমে আক্রমণ চালাতে
রাজি হয় নাঃ
“দশ গেরামের মুসলমানের মারল যখন
নমুর দলে,
শিমুলতালি গাঁয়ের যারা তাদের মারি
কিসের ছলে”?
“এক মাঠেতে লাঙ্গল ঠেলি, বৃষ্টিতে
নাই রৌদ্র পুড়ি,
সুখের বেলায়, দুখের বেলায়, ওরাই
মোদের জোড়ের জুড়ি”।
কিন্তু অপেক্ষায় থাকলে সুযোগ আবার
আসে। ঐ কাব্যের খলনায়ক নায়েবের সামনেও সুযোগ এল যখন বিয়ের রাতে দুলী বাড়ি ছেড়ে
পালিয়ে গেল সোজনের সাথে। পড়ে রইল পবিত্র ভালোবাসার কথা, মানুষের অকৃত্রিম
হ্রদয়বৃত্তির কথা, সখ্যতা আর সম্প্রীতির কথা; সব ছাপিয়ে জাত-পাত, ধর্ম, মান-
অপমান, কুল-কলঙ্কের কথা বড় হয়ে দাঁড়াল। নায়েবের প্ররোচনায় হিন্দু নমুরা মুসলমানদের
প্রতি মারমুখী হল, বেঁধে গেল গ্রামীন যুদ্ধ অর্থাৎ কাজিয়া। তাতে শ্মশান হল
শিমুলতলি গ্রাম। জমিদারের হাট বসাতে আর কোনো বাঁধাই রইল না।
ওদিকে দুরান্তরে গড়াই নদীর তীরে
পরম যত্নে গড়ে তোলা সোজন-দুলীর ছোট্ট সংসারটিও ছারখার হয়ে গেল নায়েবের কোপে। মেয়ে ফুলসানোর
অভিযোগে সোজনকে ধরিয়ে দেওয়া হল পুলিশের হাতে! আর দুলীকে ফিরিয়ে এনে নতুন করে বিয়ে
দেওয়া হল ভিনগাঁয়ে।
দীর্ঘ সাত বছর জেল খেটে এসে দুলীকে
না পেয়ে উদাসী সোজন বেদের নৌকোয় ঘুরে ফেরে, বুঝি তারই অন্বেষণে। ঘুরতে ঘুরতে একদিন
দেখাও মিলে যায়। সেদিন সোজনকে প্রত্যাখান
করা ছাড়া দুলীর উপায় ছিল না। কারণ সেখানেও সেও সমাজ সংসার ও সংস্কারের পাহাড় বড়
হয়ে দাঁড়ায়। এতদিনে সোজন সর্বস্বান্ত হয়। প্রয়োজনহীন জীবন আর বয়ে বেড়ানোর কোনও
প্রয়োজন তার কাছে অবশিষ্ট থাকে না। সে বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হয়। আর দুলী- একদিকে
সংস্কার অন্যদিকে হৃদয়ের দাবি- এ দুয়ের সংঘর্ষে বেপথু নারী রাত্রি গভীরে তার সমস্ত
হৃদয় সংরাগ নিয়ে আর একবার গৃহত্যাগ করে। নদীর কিনারে সোজন তখন মৃত্যু পথযাত্রী। এ
পরিণতি সইবার ক্ষমতা দুলী কোথায় পাবে?
“পরদিন ভোরে গাঁয়ের লোকেরা দেখিল
বালুর চরে,
একটি যুবক একটি যুবতী আছে গলাগলি
ধরে।
অঙ্গে অঙ্গে মিলিয়া অঙ্গ,
প্রাণপাখি গেছে উড়ি,
মাটির ধরায় সোনার খাঁচাটি পায়ের
আঘাতে ছুড়ি”।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ আমার চোখে
একদিকে চিরন্তন প্রেমের আলেখ্য অন্যদিকে শ্রেণিচেতনা ও সংঘর্ষের মহান কাব্যভাষা।
প্রেমোপাখ্যান হিসেবে গ্রন্থটি বহুবন্দিত, বহু আলোচিত। শ্রেণি চেতনার বিষয়টি
স্পষ্ট উঠে আসে যখন মহরমের উৎসবে বেদম মার খেয়ে ফিরে আসা নমুদের উত্তেজিত করতে
থাকেন রামনগরের নায়েব মশায়। সেই প্ররোচনায় সামনে দাঁড়িয়েও একদল কৃষিজীবী মানুষ যখন
আর একদল কৃষকের বুকে বর্শা নিক্ষেপে অসম্মত হয় তখন স্ব-শ্রেণির প্রতি ভালবাসা ও
বিশ্বস্ততার চিত্রটিই বিকাশ লাভ করে। নায়েব তাদের শ্রেণিভুক্ত নন। বরং তিনি যে
শ্রেণির, সে শ্রেণির কাছে এই অন্তজ মানুষেরা কেবল ঘৃণা ও কৃপার পাত্র।
“চাঁড়াল বলিয়া গাল দেয় যারা,
পদধূলি দিয়ে করুণা করে,
মুসলমানের গাঁও ছাড়া করি তাড়াইয়া
দিব, তাদের তরে?”
এই চেতনার কাছে তথাকথিত
‘রক্ষাকালীর আদেশ’ ও তুচ্ছ হয়ে ওঠেঃ
“‘রক্ষাকালীর আদেশ এনেছি’, স্বরূপ
তাহার বুঝেছি আজ,
যত গরীবের রক্ত চুষিয়া যাহার পূজার
হয়েছে সাজ,
মন্দির তার গড়িয়া দিয়াছে আমাদের
যারা চাঁড়াল বলে,
গরীবের ভোগ লুণ্ঠন করি দুবেলা
যাহার আহার চলে”।
এবং এই চেতনার আগুনেই শেষ পর্যন্ত
দাঙ্গা বিধ্বস্ত নমু ও মুসলমানের নবজন্ম ঘটে। সর্বহারার শ্রেণি চেতনা
বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ধনবাদের প্রতিনিধি নায়েবের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়।
“খবর খবর কিসের খবর- গুজব শুনি
গাঁয়,
রামনগরের নায়েব মশায় খোঁজ না পাওয়া
যায়।
কদিন পরে দেখল সবে বিলের ধারে
খুঁড়ে,
নায়েব মশায় আধেক দেহ ঘুমিয়ে কবর
জুড়ে”।
রচনাকালের হিসেবে ‘নকসী কাঁথার
মাঠ’ সোজনের অগ্রজ। ১৯২৯ সালে নকসী কাঁথা প্রকাশের চার বছর পরে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’
প্রকাশিত হয় (১৯৩৩)। ‘নকসী কাঁথার মাঠ’- এও আমরা কাজিয়া
দেখেছি। সে কাজিয়ার পেছনেও অর্থনীতির প্রশ্ন ছিল। তবে সে অনেকটা পরোক্ষ স্তরে।
শ্রেণি বৈষম্যের বিষয়টি সেখানে অনুপস্থিতই বলতে হবে। কিন্তু ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’- এ
এই দুটি প্রশ্নই উপস্থিত হয়েছে অত্যন্ত স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ পন্থায়। জসীমউদ্দীন এখানে
নিছক দরদী কবি মাত্র নন, সচেতন সমাজবিপ্লব। নকসী কাঁথায় যা ছিল প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত
মাত্র, এখানে তার নির্ভেজাল বহিঃপ্রকাশ। নকসী কাঁথায় যা ছিল কেবল বর্ণাত্মক, এখানে
তার শিকড়ের উদ্ভাসসহ সুষ্ঠু বিশ্লেষণ। এদিকে থেকে ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ নিঃসন্দেহে
এক মহত্ত্বর উত্তরণ।
সাগর বিশ্বাস