সাম্প্রতিক

6/recent/ticker-posts

সাগর বিশ্বাস




মানুষঃ বিনাশে ও নির্মাণে


বহু দিন আগে ডেনিস ক্যাম্পটন একটা ছোট্ট বই লিখেছিলেন Us and Themনাট্যধর্মী এই ছোট্ট বইটাতে আমরা দেখি, একদল যাযাবর মানুষ ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গায় এসেছে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। নদী, বন ও সবুজ দিগন্তজোড়া মাঠের সৌন্দর্য দেখে ওরা মুগ্ধ হয়ে গেল। ওদের মধ্যে যারা একটু চিন্তাশীল তারা দেখল, স্থায়ী বসবাসের পক্ষেও জায়গাটা খুব ভাল। সমতল মাঠে ফসল ফলানো যাবে, বনের ফল নদীর মাছ পাওয়া যাবে। আর ঘুরে বেড়ানোর দরকার হবে না।

ওরা বসতি শুরু করল। কিছুদিন বাদে আর একদল মানুষও ঘুরতে ঘুরতে সেখানে এল। তারাও সেখানে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলবে বলে মনস্থির করতে করতেই হঠাৎ আগের দলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দু’দলই তখন ভাবছে এরা আবার কারা এসে জুটল। সমস্ত সম্পদের উটকো ভাগীদার। এরা বলে এই, তোমরা কারা? ওরা বলে, তোমরা ? এরা বলে আমরা এখানে বাস করি। ওরা বলে, আমরাও করব। এরা বলে এসব জায়গা আমাদের। ওরা বলে আমাদের। শেষমেশ দু’পক্ষের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বসে ঠিক করল, অশান্তির দরকার নেই, তোমরা ওদিকটায় থাক, আমরা এদিকে। ওদিকের নদী বন মাঠ তোমাদের, এদিকের নদী বন মাঠ হল আমাদের। এলাকা বেড়া দিয়ে ভাগ করা হল।

দিন যায়। হঠাৎ একদিন বজ্রপাত সহ ঝড়বৃষ্টি। গরু, ছাগল, মুরগি এরা সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে যেদিকে পারল ছুটল। বেড়ার বাধা মানল না। ঝড় থামলে মানুষগুলো একে অন্যকে সন্দেহ করতে শুরু করল। ভাবল, সুযোগ বুঝে একে অন্যের ভালো পশু- পাখি চুরি করতে চেয়েছিল। আবার বিবাদের উপক্রম। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা আবার বৈঠক বসল। ঠিক হল, ওসব কাঁচা বেড়াটেড়ায় হিবে না। পাকা দেওয়াল তুলতে হবে, এবং সেটা এত উঁচু করে বানাতে হবে যে মুরগিগুলোও যেন উড়ে এপার- ওপার হতে না পারে। ব্যস, পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে উঁচু প্রাচীর বানানো হল। দু’পক্ষের দেখাশোনা বন্ধ হয়ে গেল।
দিন, মাস, বছর গড়িয়ে চলে। ওদের সাথে এদের দেখা হয় না। কেউ কারো খবর রাখে না। মত কিংবা ভাব বিনিময় দূরের কথা। একসময় মনে হতে থাকে, তাই তো, ওপাশের ওরা চুপচাপ কোনো মতলব ভাজছে না তো? বলা যায় না, প্রথম থেকেই লোকগুলোকে তেমন ভালো মনে হয়নি। কেবল নিজেদের স্বার্থটুকুই বোঝে।

কৌতূহল বাড়ে। আচ্চা, একবার গোপনে গোপনে দেখলে হয়, ওরা কী করছে। যেই না ভাবা অমনি কাজ। একজনের কাঁধে আর একজন, তার ওপরে আর একজন- এভাবে উঁচু হয়ে পাঁচিলের ওপাশে দৃষ্টি ফেলতেই চোখাচোখি। ওপাশ থেকেও একইভাবে উঠে দাঁড়িয়েছে একজন।

সন্দেহ এবার বদ্ধমূল হয়ে ওঠে। ওরা নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব করেছে। নইলে উঁকি আসবে কেন? নিশ্চয়ই ওরা আমাদের আক্রমণ করে এলাকা ছাড়া করতে চায়। প্রথম দিনেই তো কেমন মারমুখী ছিল।
এরপর যেটা অবধারিত তা হল ধ্বংসের খেলা। প্রাচীর গুঁড়িয়ে যায়। পরস্পর আক্রমণ করে পরস্পরকে। যুদ্ধ বাধে। এত দিনের পরিশ্রমে মানুষগুলি যা নির্মাণ করেছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে যায়। ধ্বংসের স্তুপ থেকে হয়তো বেরোয় কোনো অনিঃশেষ প্রাণ- যাযাবর মানুষের বিধ্বস্ত উত্তরসূরী। তারা হয়তো আবার কোথাও থিতু হতে চাইবে আবার শুরু হবে নির্মাণের পালা।

এভাবেই মানুষের জীবন মৃত্যু, শান্তি আর যুদ্ধের স্বরূপ দেখেছেন ডেনিস ক্যাম্পটন। যেন মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।

যুদ্ধ মনুষ্যেতর প্রাণীজগতেও হয়। কিন্তু সে মূলত ক্ষুন্নিবৃত্তি ও জীবন রক্ষার তাগিদে। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আহার্য বা শিকার নিয়ে তারা মারামারি করে, নিজের গোষ্ঠীর কেউ আক্রান্ত হলে দল বেধে আক্রমণকারীদের সঙ্গে লড়াই করে, যৌন মিলনের সময় অন্য কেউ উপগত হতে চাইলেও মারামারি হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু এসব যুদ্ধ খুবই ক্ষণস্থায়ী। আজ যার সাথে মারামারি হল, কালই তার সাথে গলাগলি হয়ে যায়।

প্রকৃতিদত্ত ভূমি, বৃক্ষ, জল কিংবা আকাশের উপর আধিপত্য অথবা বিপরীত লিঙ্গাধিকারীর প্রতি স্থায়ী অধিকার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তারা করে না।

কিন্তু মানুষ! মানুষ উন্নততর প্রাণী হিসেবে তার চিন্তাশীলতা, যুক্তি ও মনন দ্বারা যুদ্ধের অসারতা উপলব্ধি করেও যুদ্ধকে বর্জন করতে পারে না। ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিত ভাবে, দাঁতে দাঁত দিয়ে বছরের পর বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষই দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে, কি করে ধ্বংস ও নরহত্যা করতে হয়। এদিক থেকে দেখলে মানুষের মতো নৃশংস, হিংস্র ও নিষ্ঠুর প্রাণী এ পৃথিবীতে আর নেই। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ বিনাশেও আছে, নির্মাণেও আছে। সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে হয়তো তার নির্মাণের পাল্লাটাই ভারী হবে। কিন্তু বিনাশের খতিয়ানটাও বড় কম ভারী নয়। আর তার ভয়াবহ নেশা থেকে মানুষ কোনদিনই মুক্ত হতে পারেনি। ভবিষ্যতে না পারলে মানুষেরই পরাজয়।


সাগর বিশ্বাস