ইতালিতে তৈরি এই দুই নলা বন্দুকটির নাম ডবল ব্যারেল। পাশাপাশি
দুটি গুলি লোড করা যায় এতে। চাইলে দুটি গুলি একসাথে করা যায় বা একটির পর একটি।
একটা লোক গালে যার কাটা দাগ, সেই অস্ত্রটাকে ঘষে মেজে চকচকে করে নিচ্ছিল। পরখ করে
দেখে নিচ্ছিল কার্তুজগুলো।
এদিকে এই নো ম্যানস ল্যান্ডে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তিনটি লোককে।
গোলপাতার ছাউনির নিচে। আজ দু'দিন হল পেটে ওদের দানাপানি পড়েনি। কারো ঠোঁটের কোনে
জমাট বাঁধা কালচে রক্ত। কারো বা ভুরু কেটে দগদগ করছে
ঘা।
দুটো লোক থেকে থেকেই বলে উঠছে, "জল... জল...।" গালে কাটা দাগ ওয়ালা
লোকটা বিড়ি টানতে টানতে ডবল ব্যারেল হাতে ওদেরই পাহারা দিচ্ছে। একটি লোকের এখনো
জ্ঞান ফেরেনি।
এক লাখ টাকা! কথাটা শোনার পর লক্ষ্মীর পায়ের তলার মাটি সরে গেছে।
কি করবে কি না করবে বুঝে উঠতে পারল না সে। অসহায়ের মতো সে বলে উঠলো,
"লোকটাকে পই পই করে বারণ করেছিলাম এই কাজ ছেড়ে দাও... ছেড়ে দাও এই কাজ। বড়
কোন শহরে চলো চলে যাই। একটা না একটা কাজ ঠিক পাওয়া যাবে। জুটেও যাবে
দুবেলা-দুমুঠো। যদি শুনতো আমার কথা !" একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর
লক্ষী ইউনিয়নের নেতা পরিতোষ সর্দারকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, "এত টাকা আমি
কোথায় পাব দাদা ?
তুমি যা হয় কিছু একটা ব্যবস্থা করো।" পরিতোষ। বলল, "ঠিক আছে আমি দেখছি।
তবে তুই যতটা পারিস তাড়াতাড়ি টাকার বন্দোবস্ত কর।"
পরিতোষ
সর্দার চলে গেল। পরিতোষ চলে যেতেই সঞ্জয় মন্ডলের
মা বলল, "যেভাবে পারো টাকা জোগাড় করো বৌমা। আমরা টাকা জোগাড় করতে
পারিনি, তাই গেল বছর সঞ্জয়ের বাপটা সেই যে গেল আজও ঘরে ফিরল না। হয়তো মেরে
ভাসিয়েই দিয়েছে সাগরে।" সঞ্জয়ের মায়ের কথা শুনে এক অজানা আতঙ্কে হাত পা
ঠান্ডা হয়ে গেল লক্ষ্মীর। সে বলল, "কি করি বলতো কাকিমা? না আছে এক ছটাক জমি
জিরেত, আর না আছে গয়নাগাটি। এই রুপার হারটুকু ছাড়া আমার সম্বল বলতে তো ওই দুটি
ছাগল। এই হার আর দুটো ছাগল বেচে আর কতই বা টাকা পাওয়া যাবে!" লক্ষীর কথা শেষ
হতে না হতেই সঞ্জয় বলল, "কারো কাছে ধার দেনা তো করতে পারো।" "এই
বিপদের দিনে কার কাছে গিয়ে হাত পাতি বলতো? কে দেবে আমাকে ধার !", বলতে
বলতে লক্ষ্মী আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল। সঞ্জয় বলল, "যাও গিয়ে ধর অবনী
মন্ডলকে।"
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই
জেলে- বাওয়ালদের গ্রামে বেশিরভাগ মানুষেরই দিন আনি দিন খাই অবস্থা। একমাত্র অবনী
মণ্ডলেরই মাছের আড়ত। দু'খানা ট্রলারও আছে। রুপোর হার আর ছাগল দুটো বেচে অবনী
মণ্ডলের সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলে ঠিক করলো লক্ষ্মী।
চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করতেই মাথার
পিছনে অসহ্য ব্যাথা অনুভব করলো ভরত। মাথায় ব্যথা কেন... কী হয়েছে তার... মনে
করার চেষ্টা করলো ভরত।
ভরত মণ্ডলের বাড়ি সুন্দরবনের এক গ্রামে।
বয়স পঁয়ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। খাল বিল ভরা সুন্দরবনের জল-জঙ্গল থেকে নোনা কাঁকড়া ধরে
ও। সেই কাঁকড়া বাজারে বিক্রি করেই যা দু'পয়সা উপার্জন হয় তাই দিয়ে টেনেটুনে ওর
সংসার চলে। আর ফুল ফোটার মরশুম এলে সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে চাক ভেঙে মধুও সংগ্রহ
করে ও। তবে এই কাজে ওকে জঙ্গলের গহীনে যেতে হয় যার জন্য বনবিভাগের পারমিট লাগে।
অনেক টাকার ঝক্কি বলে কখনো ফরেস্টের বাবুদের পারমিট পায়না ভরত। তাই বাবুদের চোখ
এড়িয়েই কাজটা করতে হয় ওকে। ধরা পড়লেই যে কেস-এ ঝুলিয়ে দেবে বাবুরা। তাছাড়া
বনে বাঘ আর জলে কুমির তো আছেই। তবুও ভরতকে যেতে হয়। না গিয়ে উপায়ও তো নেই। বাঘ
কিংবা কুমির ওকে মারুক আর নাই মারুক, জঙ্গলে না গেলে ওকে বউ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে
মরতে হবে যে।
কিন্তু লক্ষ্মীকে কে বোঝায়! একে
ফরেস্টের বাবুদের হ্যাপা তার ওপর প্রতি মুহূর্তে প্রাণের ভয়! তাই লক্ষ্মী রোজ বলে
ভরতকে, "এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও চলে যাই চলো।" নিজের বাপ-ঠাকুরদার গ্রাম
ছেড়ে কোথায় যে যাবে, ভরত ভেবে উঠতে পারে না। তাই সে বলে, "নিজের ভিটেমাটি
ছেড়ে কোথায় যাব লক্ষ্মী?" "অন্য কোথাও। কোন শহরে। মহারাষ্ট্র অথবা তামিলনাড়ু।
দুজনেই সেখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করব। অন্তত একটু স্বস্তিতে বাঁচতে পারব সেখানে।
কিগো যাবে ?" লক্ষ্মীর জোরাজুরিতে ভরত বলে, "ঠিক আছে। কিন্তু হাতে কিছু
পয়সা-কড়ি না নিয়ে একেবারে খালি হাতে কি বিদেশ-বিভুঁইয়ে যাওয়া যায় ? শেষবারের
মতো অন্তত একবার সমুদ্রে যেতে দাও ডিঙ্গি নিয়ে। তারপর না হয় সব ছেড়ে
ছুড়ে...।" লক্ষ্মী নিমরাজি হয়ে বলে, "এটাই শেষবার কিন্তু। এরপর আর কোন
কথা শুনব না।"
তারপরই দুই সঙ্গীর সঙ্গে ডিঙ্গি
নিয়ে রওনা দেয় ভরত। রান্নার স্টোভ, হাঁড়ি, কড়া, চাল,ডাল আর খাবার জল নিয়ে।
সাত দিনের জন্য। গ্রাম থেকে নৌকাগুলো যখন পাড়ি দেয় গ্রামের মেয়ে-বউরা তাদের
বিদায় জানাতে জড়ো হয়েছিল নদী বাঁধের ওপর। আঁচলের খুঁট দাঁতে চেপে লক্ষ্মীও
দাঁড়িয়েছিল লাইনের শেষে। ভরতের নৌকা একটু এগিয়ে যেতেই লক্ষী আর নিজেকে সামলে
রাখতে পারেনি। নদী বাঁধ থেকে দৌড়ে নিচে নেমে এসেছিল সে। দাঁড় বাইতে বাইতে কিছুই
নজর এড়ায়নি ভরতের। কিন্তু তাকে যে যেতেই হবে। সেও যে নিরুপায়।
প্রথম কদিন কাঁকড়া সংগ্রহ করেই
কেটেছিল ভরত ও তার দলের। ভরত মূলত কাঁকড়া সংগ্রহ করে তিনটি পদ্ধতিতে। থোপা
পদ্ধতি, দোন পদ্ধতি আর গর্ততাড়া পদ্ধতি। থোপা পদ্ধতিতে কাঁকড়া ধরার ছিপ ব্যবহার
করা হয়। তবে এই ছিপে কোন কাঁটা থাকে না। টোপ হিসেবে কেউ মাছের টুকরো, কেউ ছোট
ব্যাঙ, কেউবা পোল্ট্রির ছাঁট ব্যবহার করে। ভরতরা সঙ্গে এনেছে পোল্ট্রির ছাঁট। থোপা
পদ্ধতি ছাড়াও দোন পদ্ধতিতেও একই রকম টোপ ব্যবহার করা হয়।এই পদ্ধতিতে একটি
লম্বা দড়িতে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর টোপ বেঁধে দেওয়া হয়। আর যাতে দড়িটি ডুবে
থাকে তার জন্য দড়ির মাঝে মাঝে ইটের টুকরো জাতীয় ভারী কিছু বেঁধে দেওয়া থাকে।
এখন জোয়ারের সময়। জোয়ারের নোনা
জল খাঁড়ি আর খাল দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে সবে। জোয়ারের জল খুব
বেড়ে গেলে তারা আর কাঁকড়া ধরতে পারবেনা। ডিঙ্গিটা এক জায়গায় নোঙ্গর করে কাজে
নেমে পড়ে ভরত ও তার দুই সঙ্গী। জলাভূমির কাদায় ভরত পুঁতে দিতে থাকে থোপা মানে
কাঁকড়া ধরার কাঁটাবিহীন ছিপগুলিকে। ভরতের এক সঙ্গী বিছিয়ে দিতে থাকে পোল্ট্রি
ছাঁটের টোপ বাঁধা দোনগুলিকে। এখন দশ পনের মিনিটের অপেক্ষা। তাই বিড়ি ধরিয়ে টান
দিতে থাকে ভরত। হাঁড়ি আর হাত জাল নিয়ে এখনই টোপগুলিকে চেক করতে যেতে হবে
টোপগুলিতে কাঁকড়া ধরল কিনা।
একে একে থোপাগুলিকে চেক করে দেখছে ভরত।
বাম হাত দিয়ে থোপার সুতো ধীরে ধীরে টেনে দেখছে ও। টোপগুলোকে আঁকড়ে ধরেছে কিনা
কোন কাঁকড়া। আঁকড়ে ধরলেই ছাঁকনির মতো হাত জাল দিয়ে ছোঁ মেরে তুলে নিচ্ছে
কাঁকড়াটিকে আর সবুজ ডালপালা ভরা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে চালান দিচ্ছে পটাপট।
একইভাবে দোন থেকেও কাঁকড়া ধরছে ওর সঙ্গীরা। জোয়ারের জল খুব বেড়ে যাওয়ার আগেই
থোপা ও দোনগুলিকে আবার গুটিয়ে রাখতে হবে ভাটার অপেক্ষায়।
শুধু যে দোন পদ্ধতি আর থোপা পদ্ধতিতেই
কাঁকড়া ধরে তা নয়, জোয়ারের জল নেমে গেলে খাল আর খাঁড়ির ধারের গর্ত খুঁড়েও ভরত
কাঁকড়া ধরে। তবে এতে অনেক বেশি পরিশ্রম লাগে। এখন ভাটার সময়। কাদা ভরা গর্ত
দেখলেই ভরত তার হাতের লোহার শিকটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে গর্তে। কাকড়ার পিঠের শক্ত খোলস
আর লোহার শিকের ধাক্কায় যে শব্দ হয়, তাতেই ভরত বুঝে নেয় গর্তে কাঁকড়া আছে
কিনা। কাঁকড়া থাকলেই গর্তটি তেড়ে লোহার শিক দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে টেনে বের
করে একেকটি কাঁকড়া। তবে খেয়াল রাখতে হয় কাঁকড়ার চিমটার মতো গোত দুটি যাতে ভেঙে
না যায়। গোত দুটি ভেঙে গেলে সেই কাঁকড়া আর বাজারে বিক্রি হবে না।
এই কদিনে বনবিবির কৃপায় ভালোই
কাঁকড়া ধরেছে ভরত। তবে কাঁকড়া ধরার চেয়ে মধু সংগ্রহ করা অনেক বেশি ঝুঁকির কাজ।
কারণ মৌচাক ভাঙতে গেলে জঙ্গলের একেবারে গহীনে যেতে হয়। কাল ভোরেই জঙ্গলের গহীনে
যাবে বলে মনস্থ করলো ভরত। খাঁড়ির জলে নৌকা ভাসছে। নৌকায় শুয়ে আছে ভরত। রাতের
খাওয়া-দাওয়ার পর কখন যে চোখে ঘুম এসে গিয়েছিলো, ভরত বুঝতেই পারেনি। জনা পনেরো
লোকের হট্টগোলে যখন ঘুম ভাঙলো ভোরের দিকে, ভরত বুঝতে পারল আর কিছু করার নেই। তাদের
ঘিরে ফেলেছে সুন্দরবনের জলদস্যুরা। হাতে তাদের বন্দুক আর পিস্তল। তবুও দস্যুদের
বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে ভরত ও তার সঙ্গীরা। আর তখনই বন্দুকের বাট দিয়ে কে যেন
আঘাত করে সজোরে। ভরতের মাথার পিছনে।
এক পাইকারের কাছে জলের দরে ছাগল দুটো বেচতে হল
লক্ষীকে। রুপার হারটাও বেচে দিয়েছে
গয়নার দোকানে। কিন্তু এই সামান্য কটা টাকায় কি হবে? অবনী মন্ডলের বাড়ির দিকে
যেতে যেতেই লক্ষীর সাথে দেখা হয়ে গেল ইউনিয়নের পরিতোষের সঙ্গে। পরিতোষ বলল,
"হ্যাঁরে টাকা জোগাড় করেছিস? ওরা খবর পাঠিয়েছে কম করে মাথাপিছু পঞ্চাশ
হাজার টাকা ওদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা না দিলে ভরতদের জ্যান্ত ফিরে পাওয়া যাবে
না।"
পঞ্চাশ হাজার টাকার বেশিরভাগটাই
অবনী মন্ডলের কাছ থেকে চড়া সুদে ধার নিয়েছে লক্ষী। সেই টাকা জমাও দেয়া হয়েছে
হাওয়ালা অ্যাকাউন্টে। লক্ষ্মী দাঁড়িয়ে আছে নদীর বাঁধে। ওর চোখ দিগন্তের দিকে।
আস্তে আস্তে চোখে ভেসে উঠছে ভরতের ডিঙ্গি। ঘরের মানুষটাকে দেখতে পেয়ে চোখের
জল বাঁধ মানছে না লক্ষ্মীর। শুধু একটাই চিন্তা এখন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে--অবনী
মন্ডলের দেনা ওরা শোধ করবে কি করে !
দূরের ওই দিগন্তে আবার সূর্য অস্ত
যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীর মনে হল ভাটার প্রচন্ড টানে ভেসে যাচ্ছে একটা
ডিঙ্গি। লক্ষী প্রানপন আটকাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। ডিঙ্গিটা ভরতকে নিয়ে একটু
একটু করে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের ঘূর্ণির ভেতর।