—" রাক্ষুসী মাগী, আমার ছেলেটারে চিবিয়ে
খেয়ে একন পর-পুরুষের জন্যি রেঁধেবেড়ে নে যেচ্ছিস ?"
চিল চিৎকারে
সারা পাড়া মাতিয়ে গালিগালাজ -গুলো হাওয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন শাশুড়ি শ্যামাসুন্দরী।
—"মর
মর... মর তুই। ওলাউঠো হয়ে মর। আবার কচিটারেও পিটে বেঁধে নে চললি? নির্লজ্জ মেয়েছেলে
কোতাকার!"
গনগনে কথাগুলোকে নিজের
ভিতরে ঢুকতে দিল না কমলি। কোন প্রত্যুত্তর না করে নীরবে কথাগুলোকে আবার বাতাসেই
মিলিয়ে যেতে দিল সে। আজ একটু বেলা করে আসবে তার হেল্পার কাম
ডেলিভারী বয় হারাধন। তাই সকাল ন'টার ভিতরে হোম ডেলিভারিতে চারটা বাড়িতে অফিসের ভাত তাকে
নিজেই পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। তারপর ফিরে এসে হারাধনকে দিয়ে ভাত পাঠাবে কলেজের
ছেলেদের একটি মেসে এবং আরও দু-চারটি বাড়িতে। আজ অনেক
কাজ তার ...অনেক কাজ ...শাশুড়ির কথা শোনার মতো সময় আজ নেই। তাড়াতাড়ি করে ফুলকিকে
বাচ্চা নেবার থলেতে বসিয়ে পিঠে তুলে দিয়ে বেল্টটা পেটে শক্ত করে বেঁধে নিল কমলি।
তারপর সাইকেলের দু'দিকে
চারবাটির টিফিন ক্যারিয়ারগুলো সাবধানে ঝুলিয়ে ভালো করে বেঁধে নিয়ে রওনা দিল। পিছনে
ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল শাশুড়ির চিল চিৎকার...
বাতের রোগে আজ প্রায় সাত
বছর ধরে বিছানায় শয্যাশায়ী শাশুড়ি শ্যামাসুন্দরী। তার ওপর সবেধন নীলমণি একমাত্র
ছেলের মৃত্যুর পর থেকে মাথাটাও কেমন খারাপ হয়ে গেছে! দিনরাত্তির ঘরে বসে বসে
খালি কমলিকে শাপশাপান্ত করে চলেছেন। আজকাল অবশ্য গালাগালিটা একটু বেশিই দিচ্ছেন।
তার কারণ পাশের বাড়ির চাঁপার কাছে তিনি অসিতবাবুর কথাটা শুনেছেন। তারপর থেকে তিনি
যেন আরও মারমুখী হয়ে উঠেছেন।
কমলির হোমডেলিভারি
"রশেবশে"-এর বয়স মেরেকেটে দু'বছর হবে। এরই মধ্যে খান পঞ্চাশেক খদ্দের তার। সঠিক মূল্যে
ও খুব যত্নসহকারে খাবারের মান বজায় রেখে খদ্দেরদের খুশি করার চেষ্টা করে সে। তাই এবছর
খদ্দের অনেকটাই বেড়েছে। তার বাপের বাড়ির অবস্থা তো ভালো ছিল না। পাঁচ ভাই-বোনের
সংসারে ছাগলের তৃতীয় সন্তানের যেমন হয়, কমলির জীবনেও তাই ঘটেছিল। পড়াশোনা করবার খুব ইচ্ছে থাকলেও
দশমশ্রেণি পার হতেই সুকুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। স্বামী সুকুমার ছিল লেদ
কারখানার মিস্ত্রি। চার'শ টাকা রোজ। সংসারে স্বচ্ছলতা না থাকলেও খেয়ে-পরে দিনগুলো
মন্দ কাটছিল না। কমালির কোন চাহিদা তো তেমন কিছু ছিল না। শুধু ওই রান্নার শখটুকু
ছাড়া। অতি সাধারণ কিছু উপকরণ দিয়েও অপূর্ব সব পদ রাঁধতে পারত সে। হাত চেটে খেয়ে
খুব প্রশংসা করত সুকুমার। তাতেই বুকটা ভরে উঠত কমলির।
কিন্তু হঠাৎ কারখানায় কাজ
করতে করতেই এক দুর্ঘটনায় সুকুমারের মৃত্যু হয়। তখন মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল কমলির। ঘরে
অসুস্থ শাশুড়ি,
ফুলকিটার
বয়স মাত্র তিন বছর। সামনে যেন অথৈ অন্ধকার দেখতে পেল সে ! দিশেহারা হয়ে কি করবে
ভেবে পেল না। লেদ কারখানার মালিক এককালীন একটা টাকা দিয়ে দায় সেরে দিলেন। একটা কাজ
দেবার জন্য তাঁদের অনেক অনুরোধ জানিয়ে -ছিল কমলি। কিন্তু মালিকপক্ষ সে অনুরোধ কানে
তোলেননি। ঠিক সেই সময়ই তাদের পাড়ার একজন ক্যাটারার নিতাইদার
সাহায্যকারী হিসেবে বিয়ে-অন্নপ্রাশন-পৈতে প্রভৃতি বিভিন্ন অনুষ্ঠান বাড়িতে রান্নার
কাজে লেগে গেল কমলি। কোনক্রমে চলছিল কিছুদিন। কিন্তু অসুস্থ শাশুড়ি
আর ছোট্ট ফুলকিকে নিয়ে কাজটা করতে ভীষণই অসুবিধে হচ্ছিল। সেজন্যই বিকল্প কাজের
খোঁজে খোঁজে ছিল সে। নিতাইদার সঙ্গে এখানে ওখানে রান্নার কাজ করতে গিয়ে সে লক্ষ্য
করেছিল যে,
আজকাল এই
মফস্বল শহরেও হোম-ডেলিভা রির বেশ চাহিদা। আর তখনই সামান্য পুঁজি নিয়েই শুরু করে
ফেলেছিল "রসেবশে"। তারপর তো ঘুরে গেছে বছর দুই । আর এখন এই কাজটায় ভীষণ
এক ভালোলাগা অনুভব করে কমলি। খাবার নিয়ে হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভুক্ত মানুষদের মুখগুলো
কেমন যেন চকচক করে ওঠে! দেখে বুকটা যেন পরম পাওয়ার আনন্দে ভরে যায়!
সময়টা চৈত্রের শেষাশেষি।
তাই আজ সকাল ন'টাতেই রোদ্দুরটা যেন চরচর
করে চামড়া জ্বালিয়ে দিচ্ছে! তার ভেতর দিয়েই সাঁই সাঁই করে সাইকেল চালাচ্ছে কমলি।
যেন বাতাসের আগে আগে যেতে পারলে তবেই সময় কুলোবে। প্রথমে সে যাবে সেন মেসোর
বাড়িতে। গত দু'মাস আগে সেন মাসীমা মারা
যাবার পর মেসো একদম একা। দুই মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন। মেসো তার খাবার খেয়ে অফিসে
বেরোন। একজন ঠিকাদারের ফার্মে হিসাব রক্ষকের কাজ করেন তিনি।কমলির ঘরোয়া খাবার তাঁর
খুব পছন্দের। তারপর সে ঢুকবে দু'জন ব্যাঙ্ককর্মীর ফ্ল্যাটে৷ বাড়ি থেকে বহুদূরে চাকরি করেন
তাঁরা। তাঁরাও কমলির খাবারের ওপর ভরসা রেখেছেন প্রথম থেকেই।
সবশেষে কমলি যাবে
অসিতবাবুর বাড়িতে। সারাদিনে একবার ঝুরুঝুরু বটের শান্ত ছায়ায় বসবার জন্য মনটা যেমন
আন -চান করে,
ঠিক তেমনি
ওই বাড়িতে যাবার জন্য মনটা আকুলি-বিকুলি করতে থাকে কমলির।
মানুষটা বড়ই গান আর ছবি পাগল! কোন কোনদিন বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই কমলি শুনতে পায় গান বাজছে। রবীন্দ্রগানের সুরে সুরে ভরে আছে
পুরো বাড়িটার আনাচকানাচ। সমস্ত বাড়িটাই যেন দুলছে সুরের ভেলায়। কখনও কখনও অসিতবাবু
নিজেও দরাজ গলায় গেয়ে ওঠেন দু'এক কলি। ভারি ভালোলাগে কমলির!
" জীবন
মরণের সীমানা ছাড়ায়ে /বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে..."
আবার কখনও
সে দেখে ক্যানভাসে কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত ছবি আপন মনে এঁকেই চলেছেন মানুষটা! কখনও
বাগানেই ছবি আঁকতে বসে যান। সারাদিন পার করে দিয়ে ভুলে যান খেতে। একটু আপন ভোলা
গোছের মানুষ যেন! বড্ড মায়া হয় কমলির। কখনও কখনও গরম ভাতটা বেড়ে তাঁকে খাইয়েও দিয়ে
আসে সে। তিনি অফিস থেকে ফিরে এলে মাঝে মাঝে আবার সন্ধেতে ভাত নিয়ে কমলি নিজে যায়
তাঁর বাড়িতে। কী যেন এক অমোঘ আকর্ষণ! ভীষণ এক ভালোলাগায় ছেয়ে থাকে কমলির বুকের ভিতরটা।
তাঁর পায়ের কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ক্যানভাসে রঙের খেলা দেখতে থাকে সেও। চা, পান, এটা ওটা হাতের কাছে এগিয়ে
দেয় হাতনুরকুৎ-এর মতো। ছবির কিছু না বুঝলেও ছবিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কী যেন একটা
অদ্ভুত ছটফটানি দুলতে থাকে কমলির বুকেও! সুর আর ছবি দুইয়েরই নেশা পেয়ে বসে কমলির
মতো সাধারণ মেয়েকেও!
তাদের পাড়ার চাঁপা
অসিতবাবুর বাড়িতে ঠিকে কাজ করে বহুদিন থেকে। তার কাছেই ঘটনাটা শুনেছে কমলি।
অসিতবাবুর বৌ নাকি কয়েক বছর হল তাঁকে ছেড়ে পর-পুরুষের হাত ধরে চলে গেছেন সংসার
ভেঙে। বাচ্চাটা- কেও নাকি সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছেন। পয়সার অভাব তো নেই, তবুও এঁদের জীবনে কীসের
যে এত অভাব তা কে জানে! ভেবে ভারী অবাক লাগে কমলির !
গত পরশুদিন বিকেলে রান্না
শেষ করে সবে গা ধুয়ে উঠেছে সে। ঠিক তখনই চাঁপা এসে উঠোনে দাঁড়ায়। চাঁপাকে দেখেই
শাশুড়ি তাঁর ঘর থেকে গালাগালির ফোয়ারা ছোটাতে থাকেন। চাঁপা তখন তার ঘরে এসে
চুপিচুপি খবর দেয়,
— " অসিতবাবু
তোকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সন্ধেতে যেন অবশ্যই একবার অল্প সময়ের জন্য হলেও যাস ও
বাড়িতে। কি নাকি বিশেষ একটা দরকার আছে!"
কথাটা শেষ
করে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসে চাঁপা!
সেদিন বাঁধভাঙা হলুদ হাসি ছড়িয়ে
একটু যেন বেশিই গাঢ় হয়ে নেমেছিল চাঁদ-সন্ধেটা! মৃদু চালে বইছিল উদাসী বাউল বাতাস।
নাম না জানা একটা বুনো গন্ধ নাক ছুঁয়ে দিচ্ছিল কমলির। সামনেই দোল পূর্ণিমা।
অসিতবাবুর বাগানে পাঁচিলের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে ছিল ঝাঁকড়া এক ফুলবতী পলাশ। বাড়ির
চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে চোখ বুজে গভীর এক নিঃশ্বাসে বুক ভরে নিয়েছিল কমলি। আর তখনই
কানে এসেছিল,
—"...মম
দুঃখবেদন মম সফল স্বপন/
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম॥"
সে সুরের
নেশা মগজের ধূসর কোষে কোষে ছড়িয়ে পড়ছিল কমলির। এসব গানের কথাগুলো প্রায়ই সে ভালো
বুঝতে পারে না,
কখনও কখনও
কথাগুলোর মানে বুঝে নেয় অসিতবাবুর কাছে। কিন্তু সেই সুর কেন যে এত আকুল করে কমলিকে, তা সে জানে না! হালকা
অন্ধকার মাখা সুরেলা বারান্দায় বসেছিলেন কমলির স্বপ্নের পুরুষ! কী বলবেন তিনি আজ? কি সেই কথা? চাঁদসন্ধেটা
যেন আরও ঘনিয়ে এসেছিল কমলির বুকে। তিনি বলেছিলেন,
— "এস।
বস এখানে।"
যেন বহুদূর
থেকে ভেসে আসছিল তাঁর গমগ- মে কন্ঠস্বর,
— "আমি
তোমার আর ফুলকির সঙ্গে নতুন করে বাঁচতে চাই, কমলি। তুমি রাজি থাকলে আমি তোমার
শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে কথা বলব।"
কী যেন এক অসম্ভব
ভালোলাগা মোচড় দিয়ে উঠেছিল কমলির বুকে। বাতাসের ডানায় তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ। সে
শব্দ যেন একটা সেতু বেঁধে দিচ্ছিল তাদের দু'জনের মাঝে। বাতাসে চুঁইয়ে পড়া
তাঁর শরীরের মৃদু পুরুষালি সুগন্ধ যেন কমলির সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অবশ করে দিচ্ছিল।
গভীর ঘোরের মধ্যে কোনক্রমে অস্ফুটে সে বলেছিল,
— "আমি
কি এত সবকিছুর যোগ্য? আমি
কি... "
কথা শেষ করতে
পারেনি কমলি। কথা গুছোতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলেছিল।
সেই সন্ধের পর থেকে
তিন-চার দিন পেরিয়ে গেছে । আজ এই সকালে ফুলকিকে পিঠে বেঁধে নিজেই অসিতবাবুর বাড়িতে
খাবার পৌঁছে দিতে এসেছে কমলি। মনের মধ্যে যেন কেমন অন্যরকম একটা কুন্ঠা বোধ কাজ
করছে। এতদিন যা করেনি। বাড়ির চৌহদ্দিতে পা দিয়েই অচেনা একটা গন্ধ টের পায় সে!
বুকটা হঠাৎ ধ্বক্ করে ওঠে তার! চোখ আটকে যায় বারান্দার কোণটিতে! আশ্চর্য হয়ে সে
দেখে, বারান্দায় বসে আছেন অতি
আধুনিকা খুব সুন্দরী একজন মহিলা আর একটি বারো-তেরো বছরের কিশোরী! কারা এরা? বিষ্ময়ে বারান্দার গ্রিলের
বাইরেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কমলি !
হঠাৎ অসিতবাবু হৈ হৈ করে
এগিয়ে এসে বলে উঠলেন,
—" কই
গো আমার ফুলকিসোনা কই? এস, এস এদিকে। এই দ্যাখো, তোমার একটা দিদি এসে
গেছে। এবার থেকে মাঝে মাঝে দিদির সঙ্গে খেলতে আসবে, কেমন?"
তারপর কমলির দিকে ফিরে বললেন,
— " মিঠিকে
নিয়ে তোমার বৌদি গতকাল রাতে বাড়িতে ফিরে
এসেছেন।"
তারপরই যেন
খুব মজার কোন কথা বলছেন এমন একটা গলায় বলে ওঠেন,
—"শুভা
কা ভুলা আগর শাম কো ঘর আ যায়ে তো উসে ভুলা নেহি ক্যাহতে ... হাঃ হাঃ হাঃ...তাই না? "
কোন কথা সরে না কমলির মুখে। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে।
বাড়ি ফিরে আসবার পথে সাইকেল চালতে
চলাতে পা দুটো'
অসাড় হয়ে
আসতে থাকে কমলির। অনেকক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা যেন পাঁজর মথিত করে তোড়ে বেরিয়ে
আসতে থাকে নিঃশব্দে। হঠাৎ তার প্রিয় সেই গানের সুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বুকে,
— "এ
মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে/তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে..."
একলা পথে
সেই সুর এসে হাত ধরে কমলির।
2 মন্তব্যসমূহ
খুব সুন্দর উপস্থাপনা। সত্যিই স্বপ্ন অধরাই থাকে দুঃখিনী কমলিদের।
উত্তরমুছুনঅপূর্ব। খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন